মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০১০

হাতুড়ে গদ্য – (একটি আত্মহত্যামূলক নোট)

_______________________________________
“আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে যে দায়ী করবো অতটা নির্মম এখনো হয়ে উঠিনি। তাই নিজের মৃত্যুর দায় কারো উপর দিয়ে যাবো না। আর জীবন থেকে পালাবার মতো কাপুরুষ হয়ে উঠার দায়ভারও আমি নিজের কাঁধেই তুলে নিলাম। যদিও জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি ছিলো?

ভালো থেকো সবাই
ভালো থেকো ফুল
ভালো থেকো পাখি
ভালো থেকো আমার প্রিয় শহরের বিষাক্ত বাতাসেরা
ভালো থেকো কয়েক হাজার ঘনফুট ধোঁয়ারা
যাদের উড়িয়ে দিয়েছি ভালোবেসে কিংবা অবহেলায়”

_________________________________________

লোকটা একটা দোকান দিয়েছিলো। সারা জীবনই যার কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। অনেকের ভীড়েও সে একাকী ভাবতো নিজেকে। দোকানে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের আনাগোনা ছিলো। তাদের সাথে সে কথা বলতো, হাসতো, দুঃখে কিছুটা হ’লেও নিজের ভিতর দুঃখ অনুভব করতো। তারপরও সে ছিলো একা। দোকান বন্ধের সময় হ’লে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব হয়ত মেলাতো, টাকা পয়সার হিসাব মেলানোর সাথে সাথে।

ছেলেটা চাকরী করতো, তার স্ত্রীও। স্বপ্ন ছিলো নিজের একটা বাড়ি। হোকনা সেকেন্ড হ্যান্ড, তবুও, নিজের একটা গাড়ি। কিছুটা স্বাচ্ছল্য। বাবা তাদেরকে কিছুরই ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। ক্ষোভ কি জেগেছিলো ভিতরে? জাগতেও পারে। নিজের চেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে একটা বাড়ির সংকুলান করছিলো। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে আলোচনাও করতো, কিভাবে কি করা যায়?

~~~~~~~~~~~~~~~~~

> দেখো বাবা কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই করতে পারেনি। সব আমার নিজের কষ্টের ফসল।
- কিন্তু তাই বলে কি বাবাকে এসব বলা উচিত তোমার?
> কি করবো বলো? বাবা যদি নিজে থেকে না বোঝে তাহলে…
- তারপরও। এটা ঠিক হচ্ছে না।

বা

- তোমার বাবা তো আধাবেলা ঘরেই বসে থাকে। তাকে দিয়ে এই কাজগুলো করানো যেতো।
> উঁহু। বাবাকে আমি কোনো কাজ করতে বলতে পারি না। হাজার হ’লেও আমার বাবা।
- তা পারবে কেনো। আজকে যদি আমার বাবা হ’তো তাহলেতো তোমার মুখেই এই কথাগুলো শুনতে হ’তো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বাবার কানে যে একেবারে যেতো না এই কথাগুলো তা না। নিজেই লজ্জায় লাল হ’তো হয়তো বাবা। হয়তো ছেলের আশ্রিত হিসেবে থাকলে এসব মেনে নিয়েই চলতে হ’বে ভাবতো।

লোকটার দোকানে অন্যান্য বাবারা আসতেন। তাদের মুখে নানা কথা শুনতো সে। দুঃখের কথা- ছেলে হয়তো বাবার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
কিংবা সুখের কথা- বাবা না চাইতেই ছেলে বাবার জন্য এটা করেছে ওটা করেছে।
শুনতো আর ভিতরে ভিতরে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতো লোকটা। নিজের বাবার কথাও মনে পড়তো হয়তো তার।

মফস্বলের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছেলেটা। ভোর বেলা স্কুলে যাবার পথে পুকুরটা। যেখানে মাছেরা প্রত্যহিক অক্সিজেন নেবার জন্য আসতো। মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো খুব জ্বালিয়ে বেড়ায়। বাবা তাকে কখনও মারে নি, যেখানে অন্য বন্ধুদের বাবার হাতে মার খাওয়া ছিলো স্কুলের রুটিনের মতো। একবার, শুধুমাত্র একবার বাবা তার কান ধরেছিলো। তারপর বাবার সেকি কান্না। অপরাধটা সেই বয়সে আর যাপিত জীবনে বেশ ভয়াবহই ছিলো। প্রতিদিন যেখানে স্কুল ছুটি হবার ঘন্টা খানেকের ভিতরই বাসায় ফিরতো সে, সেখানে সেদিন কি ভুত মাথায় চেপেছিলো দু’ আড়াই ঘন্টা বন্ধুদের সাথে স্কুলের পাশের মাঠে খেলা ধুলা করে বাসায় ফিরেছিলো। এই অপরাধটাও আসলে বড় কিছু ছিলো না, বড় ছিলো দেরী হবার কারণ হিসেবে মিথ্যে গল্পটা তৈরী করা। বাবা চুপি চুপি গিয়ে দেখে এসেছিলো তাকে।

একটা সাইকেলের খুব বেশি শখ ছিলো ছেলেটার, কিন্তু সামর্থ ছিলো না। সেটা সে বুঝেও গিয়েছিলো ঐ বয়সেই। তাই বাবার কাছে কখনও আবদারও করে নি। শুধু রাস্তার পাশে যেখানটায় চোরাই অথবা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল গুলো বিক্রি হ’তো সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল নেড়েচেড়ে দেখাটা তার অন্যতম একটা দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিলো।

বাবার নিজ হাতে লেখা আত্মহত্যার নোটটা দেখে ছেলেটার মনের সৈকতে একে একে এসে আছড়ে পড়ছিলো স্মৃতির ঢেউগুলো। চোখের কোনায় জমা হচ্ছিলো সাগরের নোনা পানি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন