মেয়েটা দাঁড়িয়ে। শীতার্ত রাতের শুরুর দিকে, মৃতপ্রায় জানালা ধরে। অসাবধানে বানানো শরবতে; গ্লাসের কার্ণিশে যেমন এক-দু’দানা চিনি লেগে থাকে, তেমনি তার চুলের কার্ণিশ ঘেঁষে কয়েকটা রোদের দানা চুপটি করে বসে ছিলো একটু ছোঁয়াতেই মিলিয়ে যাবার অপেক্ষায়। নীচে রাস্তায় টুনটুন ছন্দে রিকশার নুপুর, সাথে হাইওয়ে থেকে ভেসে আসা দুরপাল্লার যানের বেস; অন্যরকম আবহ সংগীতে ভরিয়ে তুলছে পরিবেশ।
স্বপ্নগুলো তাকে ছেড়ে যাওয়া শুরু করেছে বহুদিন থেকেই। সেই যখন সাধারণ একটা মথের জীবন ছিল। পরিবারের রেশমী সুতোর আচ্ছাদনে বছরগুলো কেটে যাচ্ছিল, তখন থেকেই স্বপ্নের ভাঙ্গণ শুরু। বাস্তবতার খরস্রোতা নদী স্বপ্নের পাড় ভেঙ্গে নতুন চর জাগার সম্ভাবনা নিয়মিত ভাবে বিলীন করে দিতো। এরপরও একটা খড়ের মতো স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছিলো সে প্রজাপতি জীবনের শুরু থেকেই। সেই খড়ের টুকরোটাও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে গত দুপুরে।
কথাছিলো, দুপুরে যখন রোদমাখা কলেজ-বারান্দার মায়া কাটিয়ে সে পুরোনো এসফল্টের রাস্তাটা দিয়ে চিরচেনা গন্তব্যের বিপরীতে হাঁটবে, তার সঙ্গী শুধু নিজের ছায়াই হবেনা। স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসা একটা কায়াও থাকবে। প্রজাপতি জীবনের শুরুতে যে খড়কুটো স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা তারই বাস্তবায়নের শুরু হবে।
ছেলেটা বসে। নিত্য-নৈমিত্তিক আনন্দবাহনে চালকের ভুমিকায়। তার বাহনে বাইরের রুক্ষ শীতেলা বাতাসের প্রবেশাধিকার নেই। বরং কৃত্রিম মসৃণ শীতল পরিবেশেই তার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। উদ্দাম ছন্দের গানে বাহনের ভেতরটা হাল্কা হয়ে আছে। পাশে বসা জনের মৃদু খুনসুটি ভেতরের পরিবেশকে বরং আরো হাল্কা করে তুলছে।
তার জন্ম, বসবাস স্বপ্নের ভিতরেই। বা এভাবে বলা যায় সে বাস্তবতাকে সবসময় স্বপ্নের সুগার-কোটিংএ পেয়েছে। যার জন্য বাস্তবতার স্বাদ কেমন, তা তার জেনে ওঠা হয়নি। যেটা তার কাছে বাস্তবতা বলে মনে হয়েছে, সেটা যে অন্য অনেকের কাছেই স্বপ্নেরও ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিস, তা সে কখনো চিন্তাও করে দেখেনি। সেজন্যই কারো কাছে যেটা খড়কুটো স্বপ্ন ধরে বাঁচার আশা, সেটা তার কাছে সাময়িক খেলার বিষয় হিসেবেই ছিল। গতদুপুরের আগ পর্যন্ত খেলনাটা বেশ দামী ছিল। এখন নতুন খেলনা নিয়ে খেলার সময়।
মুলতঃ গতসপ্তাহে পুরনো খেলনাটার আনাচ-কানাচ চেনার পর থেকেই তার নতুন খেলনায় আগ্রহ হয়েছে। এই পুরোনো খেলনাটাকে চিনতে অনেক সময় লেগে গিয়েছে। এর মাঝে যে অন্য খেলনা নিয়ে খেলা হয় নি তা না। তবে অচেনা জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকাটা স্বাভাবিক বলেই এত সময় দিতে তার কোনই সমস্যা হয় নি।
শিশু রাত এখন পূর্ণ যুবতী। কপালে অর্ধ-চাঁদের টিপ দিয়ে তারার ওড়নায় সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে। মেয়েটার অশ্রুতেও যার ছায়া পড়েছে। আরো একটা স্বপ্ন জেগেছে মরা নদীতে জাগা চরের মতোই। অর্ধ-চাঁদের টিপটাকে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। মেয়েটা ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়িঘর দিয়ে উঠে গিয়েছে ছাদে। এখান থেকে চাঁদের টিপ ছুঁয়ে দেয়া অনেক সহজ হবে। রাতও বোধহয় চায়না মেয়েটার স্বপ্ন সফল হোক। নাহলে হঠাৎ নিজের মুখটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে ফেলার কোনোই মানে হয় না। তবে মেয়েটা এখন প্রতিজ্ঞায় অটল। প্রয়োজনে সে ভেসে যাবে রাতের বুকে। চাঁদের টিপ তাকে ছুঁতেই হবে...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন