মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩

পাঠ প্রতিক্রিয়া : রশীদ করীম

ডিসেম্বর ২৬, ২০১১ - ৫:১০ অপরাহ্ন 

রশীদ করীমের উপন্যাস সমগ্র পড়া শেষ করলাম।
সেই ১৯৬১ এ লেখা প্রথম উপন্যাস “উত্তম পুরুষ” থেকে ১৯৯৩ এ লেখা শেষ উপন্যাস “লাঞ্চবক্স” পর্যন্ত। প্রথমেই বইলা রাখা ভালো, আমি কোনো সমালোচক নই। যার জন্য এই উপন্যাস সমগ্র নিয়া যা যা লিখতেছি তা সবই আমার নিজস্ব ভাবনা।
উপন্যাস সমগ্র পড়বার একটা সুবিধা আছে। বিভিন্ন সময়ে লেখকের বিভিন্ন রকম ভাবনা-চিন্তা গুলারে এক মলাটে পাওয়া যায়। তাতে লেখকের চরিত্র সম্পর্কেও মোটামুটি বেশ পরিষ্কার ধারণা জন্মায়। যাক এইসকল কথাবার্তা, পাঠ প্রতিক্রিয়ায় আসি।
রশীদ করীমের উপন্যাসে যেই দিকটা প্রথমেই আমার নজরে আসলো সেইটা হইলো, তাঁর উপন্যাসের শুরুটা সবসময়েই একই রকম। প্রথমতঃ শুরুটা খানিক আটপৌরে ভাব নিয়া করার চেষ্টা করা হয়, যেইটারে তিনি একটা বাদে কোনো উপন্যাসেই বদলাইতে পারেন নাই বা ইচ্ছাকৃত ভাবে বদলান নাই। দ্বিতীয়তঃ তাঁর উপন্যাসের দরজা দিয়া ভিতরে ঢুকতে একটু বেশিই মনোযোগ দিতে হয়। এইটা আমার কাছে বেশ ইরিটেটিং লাগছে। কিন্তু একবার ঘটনার ভিতরে ঢুকে গেলে পুরাই ঘোরগ্রস্ত হইয়া পইড়া যাইতে হয়, এই ব্যাপারটা আবার বেশ ইন্টারেস্টিং। যেন নদীতে নৌকা নিয়া বেশ দাঁড় বাইয়া ঘুর্ণিপাকের কাছে গিয়া দাঁড় ছাইড়া দেওয়া। এই দাঁড় বাইতে গিয়া শক্তি হারাইয়া ফেললে ঘূর্ণির কাছে যাওয়াও হইবো না আবার সেই ঘূর্ণিতে ডুবার আনন্দও নেওয়া হইবো না। অদ্ভুত একটা বৈপরীত্য। এই বৈপরীত্য কি একজন ভালো ঔপন্যাসিকের লক্ষণ? আমার তরফের উত্তর হইলো “না”। আমার মতে উপন্যাসের প্রবেশ দ্বারটা হইবো সহজ, যাতে পাঠকের কষ্ট কম হয়। যত বৈপরীত্য বা টুইস্ট সেগুলা ভিতরের ব্যাপার। কারণ একবার ভিতরে ঢুইকা গেলে সেই টুইস্ট গুলা গ্রহনের ক্ষমতা এমনিতেই পাঠকের ভিতর চইলা আসে।
উনার উপন্যাসে আমারে সবচাইতে বেশী আকর্ষণ করছে যেই জিনিসটা সেইটা হইলো তাঁর ঘটনার সময় নিয়া খেলার প্রবণতাটা। উনার লেখায় কখন বর্তমান, কখন দূর-অতীত, কখন নিকট-অতীতের ঘটনা বিবৃত হইতেছে সেইটার ট্র্যাক রাখাটা খুবই কঠিন। এবং এই ব্যাপারটা বেশ মজার। প্রথম দুইটা উপন্যাসের পর আমি এই ব্যাপারটা নিয়া মাথা ঘামানো ছাইড়া দিছি, আর এতে আমার লেখার রস আস্বাদনে তেমন কোনো ঝামেলাই হয় নাই। বরং লেখার হ্যালুসিনেটিং আবহটা উপভোগ করার আলাদা মজা পাইছি।
এইবার আসি তাঁর লেখার চরিত্র গুলার দিকে। উনার ভিতর আভিজাত্যের প্রতি একটা ভালোবাসা সর্বদা লালিত আছিলো সেইটা অনায়াসেই বুঝা যায় তাঁর চিত্রিত চরিত্রগুলারে দেখলে (বই শেষ করার পর ব্যাক কভারে উনার বায়োগ্রাফি পইড়া দেখলাম উনার বাইড়া উঠা কলকাতার অভিজাত পরিমণ্ডলে)।
পুরুষ চরিত্রগুলায় অভিয়াসলি তাঁর নিজের চরিত্রের ছায়া পাইছে। যেইখানে সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা একটা স্বাভাবিক ব্যাধি। চরিত্রগুলার সেই সন্দেহবাতিকগ্রস্ততারে কখনো জাস্টিফাই করা বা কখনো সেই বাতিকগ্রস্ততারে নিয়া অনুশোচনা বোধ করার ভিতর দিয়া আসলে লেখকের মনের একটা দিকই ফুইটা উঠছে বইলা আমার ধারণা। পরস্ত্রী বা নারীর প্রতি দেহজ আকর্ষণ বোধ মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। রশীদ করীমের পুরুষ চরিত্র গুলো এই বোধ মুক্ত না, এবং তার প্রকাশ একটা সততার আমেজ দেয়। এই প্রকাশ একই সাথে লেখক পাঠকের যোগসুত্র স্থাপনে যেমন সহায়তা করে তেমনই লেখক পাঠকের মধ্যে একটা মোটা দাগ দিয়া তাদের পার্থক্যটাও নির্ণয় কইরা দেয় বইলাই আমার ধারণা।
তাঁর নারী চরিত্রগুলা, প্রথম উপন্যাসের “নীলা-নীহার” ভাবি থিকা শুরু কইরা শেষের আগের উপন্যাসের “রেখা” পর্যন্ত সবাই, চিত্রিত হইছেন কিছুটা সুক্ষ্মদাগের ছলনাময়ী হিসাবে। যেখানে নারী চরিত্রগুলা অপ্রয়োজনীয় মাত্রায় শারীরি কুহক বিস্তার করেন, এবং এক পর্যায়ে পুরুষ চরিত্রগুলা সেই কুহক কাটাইয়া উঠতে সক্ষম হন বা নারী নিজেই সেই কুহক প্রত্যাহার কইরা নেন। এই কুহক সংক্রান্ত বিষয়গুলি যে খুবই মুন্সিয়ানার সাথে এক্সিকিউট করা হইছে তা কিন্তু না। কিছুটা হেলাফেলার সাথেই বিষয়গুলি আসছে, কিন্তু এত বেশীবার আসছে যে সেইটারে অবহেলা করার উপায় নাই।
লেখকের নারী শরীরের একটা বিশেষ অংশের প্রতি আকর্ষণ ভালোভাবেই চোখে বাধছে। আর এক্কেবারে শেষের লেখায় উনি এইটাকে জাস্টিফাই করার একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাও চালাইছেন। যদিও স্বীকার করতে দোষ নাই, আমার নিজেরো এই বিশেষ আকর্ষণ খুব একটা কম না।
কতগুলা উপন্যাস পইড়া কারো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়া কথা বলাটা খানিকটা ঔদ্ধত্য হইয়া যায়। তবুও এই ক্ষেত্রে আমার মনে হইতেছে এই ব্যাপারটা আলোচনায় আসা উচিত, কারণ এইটা না বললে আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া সমাপ্ত হয় না। উনার একটা কি দুইটা বাদে প্রত্যেকটা লেখায় জিন্নাহ এর কথা অনিবার্য ভাবে উইঠা আসছে। এবং উনি জিন্নাহ সাহেবের কর্মকান্ডের প্রচ্ছন্ন সমর্থক ছিলেন এইটাও বেশ বুঝা যায়। উনার চরিত্রগুলার ভিতর যে মুসলিম জাত্যাভিমান বেশ প্রবল শিকড় গাইড়া ছিলো, এইটাও উনার লেখায় দেখা যায়।
সবশেষ, রশীদ করীমের উপন্যাস গুলা পড়বার পরে আমার ব্যক্তিগত ভালোলাগার ক্রম খানিকটা এই রকম...
১. মায়ের কাছে যাচ্ছি
২. আমার যত গ্লানি
৩. বড়ই নিঃসঙ্গ
৪. সাধারণ লোকের কাহিনী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন