মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০১০

আত্মমগ্ন কথামালা

(অসতর্ক রক্তবীজ)


রৌদ্রের গান শুনে ঘুমিয়ে পড়ে বাসন্তী ফুলের সুঘ্রাণ..
ভেজা দুপুরের স্বপ্ন, ছায়াচিত্র আঁকে এলোমেলো সাপের কক্ষপথে...
গোপন জিহ্বার ঘাসদল, চেটে নেয় অসমকামী পশুদের নগ্ন বাহুমূল...
আর বিবর্ধিত জোছনারা জমা হতে থাকে ক্যামেরার শীতল ডিসপ্লে জুড়ে
ওদিকে
পদাতিক মেঘেদের মহড়ায় ঘরময় উড়তে থাকে মনখারাপের ছেঁড়া পাতা
এবং অসতর্ক সময়ের রক্তবীজ...

________________________________________________

(পথচলা, অন্ধকার স্বর্গের দিকে)

চোরাবালিতে ডুবে যেতে থাকে একরাশ রক্তাভ মেঘ
তাদের এলোমেলো কালো চুল, রাতজোছনার পাখি হয়ে ছড়িয়ে পড়ে
বৃদ্ধ গাছেদের ভাঁজ আঁকা শরীরে।

জরতপ্ত চোখে জমে থাকা বিষাদের বরফ
পৌনপুনিক ঠোঁটবদল করে আশ্রয় খুঁজে নেয় মৃত নদীর কোটরে
যেখানে, জন্মান্ধ পপেরা হামগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ানো শেখে।

একে একে সুবিন্যস্ত করে রাখা হয় সময়ের ছেঁড়া ছবিগুলো
পর্যাপ্ত লোভে ভিজিয়ে নেয়া হবে অনুকুল রোদ হেসে উঠলেই।

তৃষিত স্ট্রিটলাইটের অশ্রুতে ঢাকা পড়ে সর্পিল রাজপথ
আর তারা, ক্লান্তি ভেঙ্গে হেঁটে চলে অন্ধকার স্বর্গাভিমুখে।

_______________________________________________

(একমুঠো শহুরে জোনাকের স্মৃতি)


ওরা হাঁটছে করিডোর ধরে... আর এক এক করে জোনাকের লাশ গুনে চলছি আমরা।

শহুরে মানুষগুলো কখনো জোনাক দেখেনি
তাই তারা জানে না জোনাক হতে গেলে কাঁধে পাখা থাকতে হয়
নয়তো নিজের আগুনেই নিজের পুড়ে যাওয়ার নিয়ম লেখা গ্রন্থিত ইতিহাসে।



সেদ্ধ অর্ধসেদ্ধ জোনাকের দেহ জমে উঠছিল করিডোর জুড়ে।



ওরা হেঁটে আসছে করিডোর ধরে

ওদের হাতের মহামূল্যবান আংটি থেকে ঠিকরে পড়ছে মৃত্যুর রং

ওদের আগমনে কুয়াশা জমছে করিডরে


আমরা আর জোনাকদের লাশ গুনতে পারছি না
আমাদের দু'চোখ ভেঙ্গে নামছে অস্থির ঘুম।


একমুঠো জোনাকের মৃত্যু এখন দুঃস্বপ্নের অংশ হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে বিকেলের আকাশে।

_______________________________________________________

(নৈর্ব্যক্তিক সময়ের শব্দ)

কয়েকটা টেলিফোন বেজে উঠেছিল কোথাও
আর, রাতজাগা ঘুমেদের আস্ফালনে চাপা পড়ছিলো
বিবিধ আগুনের তাপ

ত্রিধাবিভক্ত জিহ্বা নিয়ে উল্লসিত সাধুগোত্র
অন্যের রক্তে পানপাত্র ভরে নিচ্ছে অবিরাম

পাথর চোখের কার্নিশে ঘর বাঁধা প্রজাপতি, তোমরা উড়ে চলে যাও
এখানে স্বপ্নের বলি দেয়া হবে কিছুক্ষণ পর
বেজে উঠবে বিকলাঙ্গ নর্তকীর কাঁচের চুড়ি

হাড়ের গভীরে হেঁটে যাওয়া ঘুন পোকা, তুমি কেঁদে উঠোনা
এখনি প্রস্তুত করা হবে রাজকীয় সিংহাসন
অভিষেক হবে ক্লীব জনকের যৌনাচার

কর্মীরা ফিরে চলে গেছে মেঠোপথ অসমাপ্ত রেখে
দায়ভার একা অবিরাম সময়ের ।

হাতুড়ে গদ্য (বারেকের টিভি)

বাজারের ঠিক শেষ মাথায় বারেকের চা’র দোকানটা। মৃত্যুর দিন গুনতে থাকা বুড়ো বাবলা গাছটা দাঁড়িয়ে এতদিন ধরে কিছু মানব শিশুর বিভিন্ন উচ্চতার অত্যাচার সহ্য করে আসছিল। তার চিরল পাতার ছায়ার নাগালের ভিতরেই বারেক দোকানটা শেষ পর্যন্ত বসিয়েই ফেলল। মফস্বলের এই মৃতপ্রায় বাজারে দোকান বসানোর মত নির্বুদ্ধিতা নিয়ে বাজারের লোকেরাও বারেককে কম খোঁচায়নি, সে নিজ সিদ্ধান্তে অনড়। সাধারন চা’র দোকানগুলো যেমন হয় বারেকের দোকান তা থেকে উন্নত কিছুই না। বরং খরচ কমানোর জন্য কেরসিন স্টোভের বদলে মাটির চুলা বসিয়েছে, যেটা ধরাতে তাকে প্রতি ভোরেই নাকাল হতে হয়। তবে একটা বিশেষত্ব আছে তার দোকানে। সেটা আর কিছুই না, একটা ১৪ ইঞ্চি সাদা-কালো টিভি। যার এন্টেনাটাকে একটু কায়দা করে, পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ডিশের তারের সাথে প্যাঁচ খাইয়ে দেয়া হয়েছে।

অলস দুপুরের বাবলার চিরল ছায়ায় হেলান দিয়ে অনেকেই বসে থাকে। এককাপ চায়ের সাথে একটা টোস্ট বা একটা বন নিয়ে মুলতঃ টিভির অনুষ্ঠানই সবাই খেতে পছন্দ করে। হয়ত কখনো কোন নায়কের রিকশা চালাতে চালাতে শিল্পপতির মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক তাদের হাতে থাকা শুকনো বিস্কুটকে ক্রীমের নরম আবরণে ঢেকে রাখে। নয়ত কোন গানের দৃশ্য দেখে পাশে বসা জনের পিঠে থাবা দিয়ে “মাগীর দুধ দুইটা দেখছোস? শালার অক্করে গাছপাকা আমের লাহান” বলে উত্তেজনা প্রশমণের ব্যর্থ চেষ্টায় জোরে জোরে চায়ের কাপে চুমুক দেয় কেউ। এই চুমুকের সময়ই অনেকে খেয়াল করে তাদের কাপে আর তলানি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফের জমিয়ে বসে লুঙ্গির খুট থেকে কেউ কেউ বিড়ি বের করে, কেউ বের করে খুচরো টাকা।

মাঝ সকালে আসেন কিছু বয়স্ক মানুষ। তাদের কারো মুখে তৃপ্তির আলো ঝলমল করে, কারো মুখে ভরসা হারানো আঁধারের ছোঁয়া। তাঁরা বসেন, এক বা দুই কাপ চা খান। টিভিতে দেখায় মিছিল, নাটক, রাস্তায় জ্বলতে থাকা আগুন কিংবা দেখায় রাজধানীর কোনো বড় দালানে ঢুকতে বেরোতে থাকা মানুষ। বয়স্ক চা প্রেমীরা তাকিয়ে থাকেন চুলোয় জ্বলতে থাকা আগুনের দিকে। মাঝে মাঝে চোখ তুলে টিভিতে দেখাতে থাকা বিবিধ সাদাকালো আগুনের সাথে বাস্তবের রঙ্গিন আগুনকে মিলিয়ে দেখেন। কখনো কাশির দমকে বাঁকা হতে হতে বারেককে আরেকটা আদা চা’র অর্ডার দেন কেউ। কেউ বা বাবলার শরীরে, মধ্যমায় লেগে থাকা চুনের শেষাংশ মুছতে মুছতে রক্তের মত পানের পিক ছুড়ে দেন রাস্তার ধুলোর দিকে।

নানা বয়েসী শিশুরা প্রায় সারাটা দিনই আশেপাশে খেলা ধুলা করে। আর বড়দের উচ্চারিত নানান শিক্ষা জমা রাখতে থাকে মগজের বিভিন্ন কুঠুরীতে। মাঝে মাঝেই সেগুলোর সফল প্রয়োগ চলে অপেক্ষাকৃত কম শক্তির অধিকারীর উপরে। কখোনো সখোনো দোকানে আসার উপলক্ষ্য পেলে মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে থাকে সাদাকালো শিশু বা বয়স্ক লোকেদের দিকে। কচি মনে হয়তো সাদাকালো আর রঙ্গীন বাস্তবের পার্থক্য করতে পারে না। তাদের বিস্ময় হয়ত এতটুকুই যে, এত সুন্দর করে সেজে থাকা মানুষ গুলোর মুখ বা জামা-কাপড়ে আমাদের মত রঙের ছোঁয়া নেই কেন?.

সন্ধ্যায়, দোকানীরা তাদের পসরা বন্ধ করে ঘরে ফেরার আগে, পারস্পরিক বিকি-কিনির তুলনা মূলক আলোচনার জন্য আসে। আসলে প্রতক্ষ্য আলোচনার থেকে বেশি প্রাধান্য পায় চা’র সাথে সাথে টা’র বিল দেবার সময়কার পরোক্ষ লাভ-ক্ষতির বিবরণ। এখানেও স্পষ্টতঃ দু’টো শ্রেণী দেখা যায়। যাদের সামর্থ কম তারা বেশী সময় নষ্ট না করে কোনোমতে এককাপ চা খেয়ে চলে যায়। যাবার আগে অবশ্য টিভির সাদাকালো ছবির সাথে নিজেদের সাদাকালো জীবনের মিল দেখে একটু হাসির রঙ মনের ভিতর নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটা বেশ আয়েশ করে অনেক সময় নিয়ে চা খায়। সাথে টিভির সাদাকালো রঙ এর দিকে খানিকটা উপহাস নিয়েই তাকিয়ে থাকে।

রাত অনেকখানি গভীর হলে ঝলমলে গাঢ় রঙ এর জামা-কাপড় পরা কিছু মেয়ে দোকানের আশপাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করে। তাদের কেউ কেউ এসে বসে দোকানে। তবে তারা শুধু চা’ই খায়। শুন্য দৃষ্টিতে তারা সাদাকালো টিভির মানুষ গুলোর সাথে সাথে নিজেদের কৃত্রিম রঙ্গীন সাজ আর তাদের ক্রেতাদের ভেতরের কালো চাহিদাটাকে মেলাবার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।

বারেক নিজে কখনো আগ্রহ নিয়ে তার সাদাকালো টিভির দিকে তাকায় না। সে বরং তার খদ্দেরদের মনের ভিতরের নানা রঙের খেলা যেভাবে মুখের পর্দায় ফুটে ওঠে তা নিয়েই মগ্ন থাকতে ভালবাসে। দোকানের ঝাঁপ নামাতে নামাতে বারেক ডাক দেয় “আয় আয়... তু তু তু”। কোথা থেকে জানি একটা কুকুর ছুটে আসে, বাসি বনরুটি গুলো সামনে নিয়ে কৃতজ্ঞতার রঙ ছড়িয়ে দেয় রাতের অন্ধকারে। দোকানের ভিতরে শুয়ে বারেক অনুভব করতে থাকে সাদাকালো জীবনে রঙের খেলা গুলো।

(একই বিষয়... পৌনঃপুনিক)

ঘন হয়ে আসে রাত, শরীর ও নিশ্বাস।
উদ্ধত মোরগের ঝুটির রক্তিম
নির্দেশ করে দ্রুততর বেগের
হৃদস্পন্দন, সময় এবং বাস্তব
কাঁপতে থাকে
পৌনঃপুনিক; পৌনঃপুনিক।

দিনের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরে রাতের আঁধারেরা।
আর যৌনগন্ধী স্বর নিয়ে জলকেলি রত রাজহাঁসটি
হেসে ওঠে অনিঃশেষ,
ঠোঁটে বেঁধে নিহত বেড়ালের সঘন অশ্রু।

আত্মকথন...


ইংরেজি গান শোনার অভ্যাস ওভাবে ছিলনা কখনো। মূলতঃ ইন্টার জীবন থেকে একটু একটু ইংরেজি গানের জগতে হাঁটা চলা। তবে এখনও ইংরেজি গানের প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ গড়ে ওঠেনি। আর আমার টেস্টও খানিকটা ভেজাইল্যা। কোনো স্টেশন নাই। গান শোনা শুরু জ্যাকসন দিয়ে। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মারকস, এডামস, বোল্টন, ডেনভার, ম্যাডোনা, টয়াইন, মেটালিকা, মেগাডেথ, এমিনেম ব্লা ব্লা ব্লা... সবরকম হাবিজাবিই শুনি। ভালো লাগে কিংবা লাগে না।

৯৭ বা ৯৮ এ মনেহয় একুশে টিভিতে একটা অনুষ্ঠান হ’ত এমটিভি কাউন্টডাউন বা এমটিভি টপ টেন নামে। ইউকে বা ইউএস টপ চার্ট দেখান হ’ত অনুষ্ঠানটাতে। সেখানেই প্রথম এই গানটার মিউজিক ভিডিও দেখি। এবং দেখেই পুরা তব্ধা। এরপর খোঁজাখুঁজি করে গানটা রেকর্ড করাই। লিরিক্স জোগাড় করি।

এখন পর্যন্ত এই গানটা আমার কাছে সবরকম প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। যখনই আমি হতাশায় ডুবে যেতে শুরু করি তখনই এই গানটা আমাকে সেই নিমজ্জমান অবস্থা থেকে বের করে আনে। যখনই আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিকুলতার সম্মুখীন হই এই গানটাই আমাকে নিজের পথে অটল দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। আশা রাখি এবারও গানটা আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।

গানটা জন বন জোভি এর ইট’স মাই লাইফ

আমার আজীবনের জন্য প্রিয় একটা গান।

_________________________________________

This ain't a song for the brokenhearted
No silent prayer for the faith departed
And I ain't gonna be just a face in the crowd
You're gonna hear my voice when I shout it out loud

It's my life
It's now or never
I ain't gonna live forever
I just wanna live while I'm alive

(It's my life)
My heart is like an open highway
Like Frankie said, "I did it my way"
I just wanna live while I'm alive
'Cause it's my life

This is for the ones who stood their ground
For Tommy and Gina who never backed down
Tomorrow's getting harder, make no mistake
Luck ain't even lucky, gotta make your own breaks

It's my life
And it's now or never
I ain't gonna live forever
I just wanna live while I'm alive

(It's my life)
My heart is like an open highway
Like Frankie said, "I did it my way"
I just wanna live while I'm alive
'Cause it's my life

You better stand tall
When they're calling you out
Don't bend, don't break
Baby, don't back down

It's my life
It's now or never
'Cause I ain't gonna live forever
I just wanna live while I'm alive

(It's my life)
My heart is like an open highway
Like Frankie said, "I did it my way"
I just wanna live while I'm alive

(It's my life)
And it's now or never
I ain't gonna live forever
I just wanna live while I'm alive

(It's my life)
My heart is like an open highway
Like Frankie said, "I did it my way"
I just wanna live while I'm alive
'Cause it's my life!

হাতুড়ে গদ্য (ক্যাকফনি**)

সন্ধ্যার ঝিম ধরানো সিগন্যালে; এলোমেলো কিন্তু সারিবদ্ধ ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোর চিৎকার শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ আলফেসানী, কানে ইয়ার-প্লাগের হোসপাইপ লাগিয়ে মগজের শুকনো জমিতে কিছু শব্দ আর ছন্দের চাষে ব্যাস্ত ছিলো। হঠাৎই রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে স্মৃতির কলসি ভেঙ্গে একঝাঁক কোমল ছবি ছড়িয়ে ফেলল এদিকে সেদিকে।
-----------
চন্দ্রলোপার ছিপছিপে শরীরটা জড়িয়ে আছে দুধসাদা কামিজ যার উর্বর জমিন জুড়ে অসংখ্য সীমের ফুল। আংগুলের সকল মমতা দিয়ে ধরা কালো কালির একটা বলপয়েন্ট। একচিলতে বিকেলের রোদ তার চুল আর চোখের কার্ণিশ বেয়ে নেমে এসে খাতার এক কোণে লক্ষী বেড়াল হয়ে বসেছে।
------------
বেশ অনেকদিন ধরেই হাল্কা ধুসর মনখারাপের ধুলো জমা হচ্ছে আলফেসানীর ঘরের মেঝেতে। আজকে সেখানে ঢুকে দেখলো আনন্দের পায়ের ছাপ গুলো প্রায় অদৃশ্য হয়ে এসেছে। কোনায় কোনায় বাস্তবতার মাকড়শার ঝুলে ছেয়ে গিয়েছে। চোখ বন্ধ করে এগুলোই দেখছিলো সে। হয়ত ঘরে ঝুলিয়ে রাখা কোমল ছবিগুলোও খুঁজে ফিরছিলো।
-----------
সন্ধ্যাভিমুখী মৃদু আলোর রাস্তায় চন্দ্রলোপা আর তার সাথীদের সামনে দিয়ে উদাসীন ভঙ্গীতে হেঁটে যেতে যেতে; সদ্য যৌবন ছোঁয়া ঠোঁটে, শো-অফের চিন্তায় উদ্বিগ্ন ধোঁয়ার আড়াল তৈরী করা। সাথে আড়চোখে চন্দ্রলোপার চোখের কুঁড়ির পূর্ণাঙ্গ ফুলে পরিণত হয়ে ওঠা উপভোগ।
------------
আলো-আঁধারীতে যে আবছা বয়েসের আদল ফুটে উঠেছে তাতে মেয়েটার চন্দ্রলোপা না হবার সম্ভাবনাই বেশি। কিছুক্ষণ আগের অবস্থান থেকে পেটমোটা রিকশাটা এগিয়ে আসাতেই এই বিপত্তিটা দেখা দিয়েছে। আলফেসানীর তখনকার মোলায়েম মাটির হৃদয়ে যেই কোমল ছবিগুলো আঁকা হয়েছিলো সেগুলোর বয়েস একবিন্দুও বাড়েনি। রিকশায় বসে থাকা চন্দ্রলোপাও সেই সদ্য যৌবনের সবটুকু গৌরব নিয়ে অবিচল।

আলফেসানীর একই সাথে খুব ইচ্ছে হচ্ছে পিপড়ের পেটের ভিতর থেকে বের হয়ে এই চন্দ্রলোপার সাথে পরিচিত হতে, আবার মনের গহীণ কুয়ার ভেতর থেকে পুরোনো চন্দ্রলোপার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। যেই শব্দের প্রতিটা ছোঁয়া মনখারাপের ধুলো পড়া ঘরের কোমল ছবিগুলোর স্পটলাইট এক এক করে জ্বালিয়ে তুলছে।







____________________________________________

**cacophony

1. harsh discordance of sound; dissonance: a cacophony of hoots, cackles, and wails.
2. a discordant and meaningless mixture of sounds: the cacophony produced by city traffic at midday.
3. Music. frequent use of discords of a harshness and relationship difficult to understand.

_____________________________________________

(কবি ও নগ্ন গিটার)

একটা নগ্ন গিটার শুয়ে আছে কবির কোল জুড়ে |

ষড়-রিপুর টিউনিং নিয়ে ব্যস্ত অস্থির আঙ্গুল,
জ্বলতে থাকা নিকোটিনের পলি জমা হতে থাকে
আঁধো আলোকাচ্ছন্ন গাছের এবং ফুসফুসের পাতায়;

অমোঘ বীণ-বাদকের কড়ি চালানে ছুটে আসা
বিবিধ সাপের সুরেলা হিসহিসে
মগ্ন হয়ে পড়ে ঘড়ির তিনটি কাঁটা,
সময়েরা, গলিত জোছনার সাথে তাল মিলিয়ে
বয়ে যেতে থাকে চায়ের কাপ থেকে কাপে,
অচেনা আলোর জেব্রা-ক্রসিংয়ে নিশি যাপনের স্বপ্নরা
ফিরে যায় বাস্তবের কোমল আহ্বানে |

(মৃত্যু)

আয়না তে দেখি দু'টো অপরিচিত চোখ তাকিয়ে রয়েছে;
সকালের জুতো গুলো চিত্কার করে বলে চিনি না তোমাকে।
শার্ট বা টি-শার্টেরা, মনিব গন্ধ ভুলে যাওয়া কুকুরের মত
দুরে দুরে সরে যেতে চায়।
গলার স্বরে শুকনো পাতাদের প্রতিধ্বনি
চমকে দেয়,
দুপুরের রোদ-বিকেলের প্রলম্বিত ছায়া-রাতের নিঃশব্দ ঘেরা অন্ধকার।

ধুলিকনার চুমু তে শিহরিত, মৃত এবং উত্থান রহিত দেহের প্রতিটি কোষ |

হাতুড়ে রুপকথা (পান্না চৌখি জল ফরিং আর নারিকোলিয়া চন্দ্রহার)

রইদের পাহাড়ে পান্না চৌখি জল ফরিঙের ঘর |

অন্ধ সোলেমান সদাগর জীবনের শ্যাষ সদাগরী করতে গিয়াছিল রইদের পাহাড়ে। সতের শহর আর দশটা মহাশহর পাড়ি দিয়া। পান্না চৌখি জল ফরিঙের খোঁজে, এইবার তার লগে আছিল তার জওয়ান পোলা আমিরজান।

জবরদস্ত জমিদার সাব কইয়া দিসিলেন তার মাইয়ার বিবাহের লাগিয়া অলংকার আননের কথা। মাইয়ার নাম ছালেহা গুণবতী। আমিরজানের মনের ভিতর আছিল ছালেহা গুনবতির লাগিয়া ভাব-ভালবাসা। ছালেহা গুনবতিও আমিরজানের লাগিয়া দিলের ভিতর হাহাকার শুনিতে পাইত |

জবরদস্ত জমিদার সাবের একই কথা আমার কন্যার লাগিয়া নিজেরে প্রমান করিতে হইব আমিরজানেরে। আনিতে হইব নানান কিসিমের অলংকার |

নারিকোলিয়া চন্দ্রহার, কালা রুপার পায়ের খারু, লাল স্বর্ণের কাঁকন, সাদা স্বর্ণের টিকলি, হইলদা হীরার কানপাশা যদি আনিতে না পারো তবে তোমার বদন আর আমার সম্মুখে আনিব না। গোপনে আমিরজানরে ডাকিয়া বইলা দিসিলো জবরদস্ত জমিদার |

জওয়ান আমিরজান। কোনো বিপদরেই সে বিপদ মনে করে না। বাপের লাহানই হইছে। গলায়ও বাপের চাইতে বেশি সুর খেলে তার। ছালেহা গুনবতিরে লইয়া গান বান্ধে মনের হুতাশ তাড়ানোর লাগিয়া। রাইতে যখন ঝকমক চান্দ আকাশের সমুদ্দুরে ভাইসা বেড়ায় আমিরজানের ভরাট স্বরের গান তার কানে সুধার ভান্ড উপচায়া দেয় |

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

গুণবতীর কথা আমি কি বলিব আর
সারা দেহ ভরা কেবল গুণেরই আধার
গুনভরা হাত ও রে তার গুণভরা মন
তাহার গুনের কথা করিব বর্ণন
হাতের মাঝে আছে যে তার রন্ধনের ফুল
চোখের মাঝে আছে য্যানো সকল সুখের মূল...


~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

রইদের পাহাড়ে হাজারে-বিজারে পান্না চৌখি জল ফরিং। সোলেমান সদাগরের নির্দেশ পাইয়া আমিরজান হাতে মিহি জাল লইয়া পান্না চৌখি ফরিঙের পিছনে দৌরঝাঁপে নামে। নিমেষেই খাঁচায় পুইরা ফেলে শ'য়ে শ'য়ে পান্না চৌখি ফরিং |

এই যাত্রায় মহাশহর গুলাতে পান্না চৌখি জল ফরিংয়ের চাহিদা অনেক আছিল। সদাগরি করিয়া জওয়ান আমিরজান সদাগরের লাভের অংক আশার দরজা পার হইয়া যায়। সোলেমান সদাগর এইবেলা নামে পোলার বিবাহের সওদায়। নাম ধরিয়া ধরিয়া সকল কিছুই খরিদ করে সোলেমান সদাগর। কেবল খুঁজিয়া পায়না নারকোলিয়া চন্দ্রহার।

খোঁজ লাগায় এই শহরে
খোঁজ লাগায় ওই মহাশহরে
খোঁজ লাগায় কালাপানিয়ায়
খোঁজ লাগায় ধলাদরিয়ায়
খোঁজ খোঁজ খোঁজ...

শেষতক খোঁজ মেলে সরু নদের গাঁওয়ে।
খোঁজ দেয় নারাণ কোবরেজ। ছয় পহরের তপ্ত মরু পার হইয়া, তিন রাতের নারকোল বন। সেই বনের নারকোলের পাতায় চুঁইয়া পড়ে চান্দের জোছনা। আর গাছের তলায় জমে নারিকোলিয়া চন্দ্রমধু। এই মধু, তুলিতে হইব যেই কন্যা চন্দ্রহার পড়িবে তাহার নামে। রাখিতে হইবে নারকোল বনের পাতার তৈরি মধু ভান্ডে। এইবেলা মধু লইয়া যাইতে হইব নয় আঙ্গুলের সোনারুর কাছে। সে কেবলমাত্র সেই পারে নারিকোলিয়া চন্দ্রহার বানাইতে।
খবরদার মধু সংগ্রহের কালে জানি দুলা একা থাকে। আর কন্যার নাম ছাড়া অইন্য কারো নাম জানি দুলার মনে না থাকে। বাপের কতা মনে আছিল আমিরজানের। কানে তুলা গুইজা, চক্ষু চেককাটা গামছায় বাইন্দা রওয়ানা হইল সে। নারিকোলিয়া বনে গিয়া চক্ষুর বান্ধন খুইলা, কানের তুলা ফেলাইয়া আমিরজানে নারকোলের পাতার ভান্ড তৈয়ার করে। সেই ভান্ডে জমা করে নারিকোলিয়া চন্দ্রমধু। এরপর পৌছায়া যায় নয় আঙ্গুলের সোনারুর দরোজায়। শব্দ করতেই দরোজা খুলতে আসে নয় আঙ্গুলের সোনারুর মাইয়া।

// কে গা আপনে?
\\ অন্ধ সোলেমান সদাগরের পোলা আমিরজান। আপনের পরিচয়?
// নয় আঙ্গুলের সোনারুর কইন্যা আমি, নাম স্বর্ণা রাণী সোনারু। বাপজানের কাছে কি কাম?
\\ নারিকোলিয়া চন্দ্রহার তৈরীর লাগিয়া নারিকোলিয়া চন্দ্রমধু নিয়া আসছি।


নয় আঙ্গুলের সোনারুর হাতে নারিকোলিয়া চন্দ্রমধু তুলে দিবার কালে আমিরজান জপ করতেছিলো ছালেহা গুণবতীর নাম। একবার খালি মনের ভুলে তাকায়া ফেলছিলো স্বর্ণা রাণী সোনারুর পানে। ঐ একবারই। নয় আঙ্গুলের সোনারু চক্ষু রক্তবর্ণ হইয়া উঠল। দাঁড়ির জঙ্গল থিকা জানি রাগী বাঘ ডাইকা উঠল।

- এই হার তৈয়ার হইবে না। তুমি জানোনা হারের মালকীন ছাড়া অন্য কারো নাম লইলে হার তৈয়ার অসম্ভব?
= সোনারু হুজুর এমন কথা বইলেন না। ছালেহা গুণবতী আমার পথ চাইয়া দিন গুনতেছে।
- নারিকোলিয়া চন্দ্রমধু শুদ্ধ করতে হইবো। তবেই সম্ভব হার তইয়ার।
= কেমনে শুদ্ধ করিব?
- তোমার হৃদয় ছিদ্র কইরা পঞ্চ ফোঁটা রক্ত আর তোমার ডাহিন হস্তের কবজি।


~~~~~~~~~~~~~~
ছালেহা গুণবতীর দিলে আমিরজানের লাগিয়া হাহাকার আছিল। ভাব-ভালবাসা নহে।
~~~~~~~~~~~~~~

লুলা আমিরজান নয় আঙ্গুলের সোনারুর কাছে ফিরিয়া তাহারে ওস্তাদ মানিয়া কর্ম শিখিতে লাগিল। আর অন্ধ সোলেমান সদাগর তাহার স্ত্রী শরীফা সুন্দরীরে লইয়া অজানার উদ্দেশ্যে নাও ভাসাইয়া দিল।

হাতুড়ে গদ্য (স্বপ্নাহত)

মেয়েটা দাঁড়িয়ে। শীতার্ত রাতের শুরুর দিকে, মৃতপ্রায় জানালা ধরে। অসাবধানে বানানো শরবতে; গ্লাসের কার্ণিশে যেমন এক-দু’দানা চিনি লেগে থাকে, তেমনি তার চুলের কার্ণিশ ঘেঁষে কয়েকটা রোদের দানা চুপটি করে বসে ছিলো একটু ছোঁয়াতেই মিলিয়ে যাবার অপেক্ষায়। নীচে রাস্তায় টুনটুন ছন্দে রিকশার নুপুর, সাথে হাইওয়ে থেকে ভেসে আসা দুরপাল্লার যানের বেস; অন্যরকম আবহ সংগীতে ভরিয়ে তুলছে পরিবেশ।

স্বপ্নগুলো তাকে ছেড়ে যাওয়া শুরু করেছে বহুদিন থেকেই। সেই যখন সাধারণ একটা মথের জীবন ছিল। পরিবারের রেশমী সুতোর আচ্ছাদনে বছরগুলো কেটে যাচ্ছিল, তখন থেকেই স্বপ্নের ভাঙ্গণ শুরু। বাস্তবতার খরস্রোতা নদী স্বপ্নের পাড় ভেঙ্গে নতুন চর জাগার সম্ভাবনা নিয়মিত ভাবে বিলীন করে দিতো। এরপরও একটা খড়ের মতো স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছিলো সে প্রজাপতি জীবনের শুরু থেকেই। সেই খড়ের টুকরোটাও হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে গত দুপুরে।

কথাছিলো, দুপুরে যখন রোদমাখা কলেজ-বারান্দার মায়া কাটিয়ে সে পুরোনো এসফল্টের রাস্তাটা দিয়ে চিরচেনা গন্তব্যের বিপরীতে হাঁটবে, তার সঙ্গী শুধু নিজের ছায়াই হবেনা। স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসা একটা কায়াও থাকবে। প্রজাপতি জীবনের শুরুতে যে খড়কুটো স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা তারই বাস্তবায়নের শুরু হবে।


ছেলেটা বসে। নিত্য-নৈমিত্তিক আনন্দবাহনে চালকের ভুমিকায়। তার বাহনে বাইরের রুক্ষ শীতেলা বাতাসের প্রবেশাধিকার নেই। বরং কৃত্রিম মসৃণ শীতল পরিবেশেই তার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। উদ্দাম ছন্দের গানে বাহনের ভেতরটা হাল্কা হয়ে আছে। পাশে বসা জনের মৃদু খুনসুটি ভেতরের পরিবেশকে বরং আরো হাল্কা করে তুলছে।

তার জন্ম, বসবাস স্বপ্নের ভিতরেই। বা এভাবে বলা যায় সে বাস্তবতাকে সবসময় স্বপ্নের সুগার-কোটিংএ পেয়েছে। যার জন্য বাস্তবতার স্বাদ কেমন, তা তার জেনে ওঠা হয়নি। যেটা তার কাছে বাস্তবতা বলে মনে হয়েছে, সেটা যে অন্য অনেকের কাছেই স্বপ্নেরও ধরাছোঁয়ার বাইরের জিনিস, তা সে কখনো চিন্তাও করে দেখেনি। সেজন্যই কারো কাছে যেটা খড়কুটো স্বপ্ন ধরে বাঁচার আশা, সেটা তার কাছে সাময়িক খেলার বিষয় হিসেবেই ছিল। গতদুপুরের আগ পর্যন্ত খেলনাটা বেশ দামী ছিল। এখন নতুন খেলনা নিয়ে খেলার সময়।

মুলতঃ গতসপ্তাহে পুরনো খেলনাটার আনাচ-কানাচ চেনার পর থেকেই তার নতুন খেলনায় আগ্রহ হয়েছে। এই পুরোনো খেলনাটাকে চিনতে অনেক সময় লেগে গিয়েছে। এর মাঝে যে অন্য খেলনা নিয়ে খেলা হয় নি তা না। তবে অচেনা জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকাটা স্বাভাবিক বলেই এত সময় দিতে তার কোনই সমস্যা হয় নি।



শিশু রাত এখন পূর্ণ যুবতী। কপালে অর্ধ-চাঁদের টিপ দিয়ে তারার ওড়নায় সাজিয়ে নিয়েছে নিজেকে। মেয়েটার অশ্রুতেও যার ছায়া পড়েছে। আরো একটা স্বপ্ন জেগেছে মরা নদীতে জাগা চরের মতোই। অর্ধ-চাঁদের টিপটাকে ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন। মেয়েটা ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়িঘর দিয়ে উঠে গিয়েছে ছাদে। এখান থেকে চাঁদের টিপ ছুঁয়ে দেয়া অনেক সহজ হবে। রাতও বোধহয় চায়না মেয়েটার স্বপ্ন সফল হোক। নাহলে হঠাৎ নিজের মুখটা কুয়াশার চাদরে ঢেকে ফেলার কোনোই মানে হয় না। তবে মেয়েটা এখন প্রতিজ্ঞায় অটল। প্রয়োজনে সে ভেসে যাবে রাতের বুকে। চাঁদের টিপ তাকে ছুঁতেই হবে...

(শরীরের গান)

*

আমি দুরে বসে সিগারেটের সাথে কুয়াশার মিল খুঁজে ফিরি| আর টুপটাপ করে ক্লান্ত শিশির ঝরতে থাকে রাতের মসৃন সমভূমি বেয়ে| গানওয়ালারা সকল সুর ভুলে হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেছে বহুদূরের বিছানায়| লেপের ওম|
বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা করে শরীরের কানাগলিতে| কাগজের নৌকায় ভেসে আসা শব্দগুলো... চিরে চিরে ফেলে নিস্তব্ধতার জমাট বরফ|

**

দুই শরীরজাত গান হয়তো দারুন শ্রুতিমধুর| তা নাহলে নারী ও পুরুষ কেন সারাক্ষণ এই গানে আরো বেশি পারফেকশন আনবার চেষ্টা চালিয়ে যায়?

***

ঠোঁটের আর্দ্রতায় ভিজে আসে ঠোঁট| প্রত্যেকেরই জোড় বাঁধবার প্রবণতা| সকালের রোদ যেমন তোমার আলতো গালে ছুঁয়ে যায়| অশ্রুরা উথলে ওঠে নেশাতুর দু'চোখের ভিতর| চেপে রাখার চেষ্টায় ফুলে ফুলে ওঠে এলোমেলো পিঠ| থরথর কাঁপতে থাকে পুষে রাখা পায়রা দু'টো| অদম্য ভালোলাগার তাল তাল রঙ ছড়িয়ে যায় মনের আনাচে কানাচে...

****

সর্ষে তেলের পিদিম জ্বলে ঘরের কোণে| কাজলদানীতে জমা হতে থাকে কালো রক্তের কাজল| ঘুম ঘুম দুপুর বেড়ালদের নিঃশব্দ পায়ের শব্দে মুখর হয়ে ওঠে| আর কার্নিশ থেকে ডানা ঝাপটে উড়ে যায় নিঃসঙ্গ শালিক...

(স্বপ্ন ব্যাবচ্ছেদ: ব্যবচ্ছেদ পর্ব)

নির্দেশ পৌছুবার পর...

প্রজাপতির পাখায় জমা আনন্দ গুলো একে একে তুলে নেয়া হয়

পুঞ্জাক্ষীতে কালো ধোঁয়া, শশ্মানের গন্ধ জমাট।
জ্যামিতিক সময়ের সমকোনে বেদনা আর সমান্তরালে অশ্রু
নিখুঁত খন্ডচিত্র।

স্বপ্নের উল্লম্বচ্ছেদে রোদেরা মৃদু পায়ে সরে যেতে থাকে
________দুরে
_________________দুরে থেকে
_____________________________আরো দুরে
__________________________________________অনেক অনেক দুরে

জলসুত্র লেখা হয় বাঁ-চোখে, অন্ধবিন্দুর গহীন প্রান্তর জুড়ে
কিংবা, কিংবদন্তীর সকল পাতায় ও রাজপুত্রের কিংখাবে।

গন্ধপূরাণ

মানুষের স্মৃতিতে কোন অনুভুতিটা সবচে প্রথম মনেহয় স্পর্শ। এর পরপরই যে অনুভুতিটা ছাপ ফেলে সেটা হ'লো, অন্ততঃ আমার ধারণায়, গন্ধ। শিশুবেলা থেকে একটা মানুষ তার আশপাশের মানুষদের সাথে তাদের গন্ধ দিয়ে পরিচিত হয়। আমি অবশ্য এখানে এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসিনাই। আমি আসলে শিশুবেলার যেসব গন্ধগুলো আমি এখনো ভালোবাসি সেগুলো নিয়ে স্মৃতিচারণ টাইপ কিছু লেখার চেষ্টা করছি। যদিও আমার কাঠখোট্টা লেখার ধরন কারো ভালো লাগবে কিনা জানি না।

আম্মুর গায়ের গন্ধ

যখন কিছু কিছু বুঝতে শিখেছি তখন থেকে আম্মুর গায়ের গন্ধকে আমি খানিকটা পোলাওয়ের চাল সাথে খানিকটা অন্য কিসের জেনো মিক্সড একটা গন্ধ হিসেবে ডিফাইন করি। এখনও মাঝে মাঝে আম্মুর গন্ধটা নিতে ভালোবাসি...

নেইলপলিশের গন্ধ

দাদু (বড় বোন) যখন নেইলপলিশ দিতো। আমি দাদুর পাশে বসে থাকতাম শুধুমাত্র নেইলপলিশের গন্ধটা নেবার জন্য। পাঁচ বা দশ পয়সার কয়েন দিয়ে রাখতো বোতলটার উপর যাতে তাড়াতাড়ি না শুকিয়ে যায়। আর আমি সেই কয়েনটা সরিয়ে নাকের কাছে বোতল ধরে প্রাণভরে নিতাম নেলপলিশের গন্ধ। কিছু গন্ধ আছে যেগুলো আমার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। নেলপলিশের গন্ধ তার ভিতর একটা।

শিশুদের মুখের গন্ধ

যেই পিচকিরা মায়ের দুধ খায় তাদের মুখে একটা অলৌকিক গন্ধ পাওয়া যায়। আমার ছোটবোনটা যখন ছোট ছিলো তখন তাকে কোলে নেবার অন্যতম আকর্ষণ ছিলো এই গন্ধটা। এখনো পিচ্চিদের কোলে নিয়ে আমি প্রথমেই গন্ধটা খুঁজি। দুঃখের কথা হ'লো যে আমি এখন খুব কম পিচকির মুখেই এই গন্ধটা পাই।

ফিডারের গন্ধ

আমার একটা ফিডার ছিলো। কাঁচের। দুই পাশে নিপল ওয়ালা। সেইটায় একটা মজার গন্ধ পেতাম। এখন ঐ গন্ধটাকে খুবই মিস করি।

বার্নিশের গন্ধ

কাঠে যখন বার্নিশ করা হয় তখন মিথাইল এ্যলকোহলের একটা অন্যরকম গন্ধ পাওয়া যায়। এটাও আমার খাবার ইচ্ছা জাগানো একটা গন্ধ।

ওষুধের গন্ধ

ফাইমক্সিল বলে একটা সিরাপ। এখন বুঝি ওটাকে নাকি ভ্যানিলা ফ্লেভার বলে। শিশুবেলায় ওটাকে কলা ওষুধ বলতাম। গন্ধটা কলার মতো না, কিন্তু এখনো ওটাকে কলা ওষুধ বলতেই বেশি ভালো লাগে।

এছাড়াও ভালোলাগা গন্ধের ভিতর আছে কেরোসিনের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, শুকনো পাতা পোড়ানোর গন্ধ।

এটা একটু বয়স্ক বয়সে যে গন্ধটার প্রেমে পড়েছি সেটা হ'লো

মাটির গন্ধ

ঠিক মাটির গন্ধ না। দুই-চার দিন কড়া রোদে রাস্তাঘাট ঝলসে যাবার পর যখন কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ে তখন মাটি থেকে যেই মিষ্টি গন্ধটা আসে সেটার প্রেমে আমি এখন দিওয়ানা।

(স্বপ্ন ব্যবচ্ছেদ: প্রস্তুতি পর্ব)

দিনের অভিনয় শেষে বিছানায় ফিরে আসা দাঁতাল বাঘ
জিভের ডগায় বয়ে নিয়ে সকল ফুলেল
স্বপ্ন ভরা মগজ, চোখ; খুবলে তুলে নেয় যান্ত্রিক হাত
একটি স্বপ্নের ব্যবচ্ছেদ করা হবে
স্কালপেল,
হাইপোডরমিক নিডল,
স্প্লিন্টার ফরসেপ,
স্টেরিলাইজড থ্রেড
সব সাজানো হয়েছে চকচকে স্টীল ট্রে'তে।
শুধু নির্দেশের অপেক্ষা
তারপর দাঁতাল বাঘ,
নিজেই নেমে পড়বে স্বপ্ন নিয়ে কাটা-ছেঁড়া করতে।

হাতুড়ে গদ্য – (একটি আত্মহত্যামূলক নোট)

_______________________________________
“আমার মৃত্যুর জন্য কাউকে যে দায়ী করবো অতটা নির্মম এখনো হয়ে উঠিনি। তাই নিজের মৃত্যুর দায় কারো উপর দিয়ে যাবো না। আর জীবন থেকে পালাবার মতো কাপুরুষ হয়ে উঠার দায়ভারও আমি নিজের কাঁধেই তুলে নিলাম। যদিও জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি ছিলো?

ভালো থেকো সবাই
ভালো থেকো ফুল
ভালো থেকো পাখি
ভালো থেকো আমার প্রিয় শহরের বিষাক্ত বাতাসেরা
ভালো থেকো কয়েক হাজার ঘনফুট ধোঁয়ারা
যাদের উড়িয়ে দিয়েছি ভালোবেসে কিংবা অবহেলায়”

_________________________________________

লোকটা একটা দোকান দিয়েছিলো। সারা জীবনই যার কেটেছে নিঃসঙ্গতায়। অনেকের ভীড়েও সে একাকী ভাবতো নিজেকে। দোকানে শ’য়ে শ’য়ে মানুষের আনাগোনা ছিলো। তাদের সাথে সে কথা বলতো, হাসতো, দুঃখে কিছুটা হ’লেও নিজের ভিতর দুঃখ অনুভব করতো। তারপরও সে ছিলো একা। দোকান বন্ধের সময় হ’লে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসাব হয়ত মেলাতো, টাকা পয়সার হিসাব মেলানোর সাথে সাথে।

ছেলেটা চাকরী করতো, তার স্ত্রীও। স্বপ্ন ছিলো নিজের একটা বাড়ি। হোকনা সেকেন্ড হ্যান্ড, তবুও, নিজের একটা গাড়ি। কিছুটা স্বাচ্ছল্য। বাবা তাদেরকে কিছুরই ব্যবস্থা করে দিতে পারেনি। ক্ষোভ কি জেগেছিলো ভিতরে? জাগতেও পারে। নিজের চেষ্টা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে একটা বাড়ির সংকুলান করছিলো। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে আলোচনাও করতো, কিভাবে কি করা যায়?

~~~~~~~~~~~~~~~~~

> দেখো বাবা কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই করতে পারেনি। সব আমার নিজের কষ্টের ফসল।
- কিন্তু তাই বলে কি বাবাকে এসব বলা উচিত তোমার?
> কি করবো বলো? বাবা যদি নিজে থেকে না বোঝে তাহলে…
- তারপরও। এটা ঠিক হচ্ছে না।

বা

- তোমার বাবা তো আধাবেলা ঘরেই বসে থাকে। তাকে দিয়ে এই কাজগুলো করানো যেতো।
> উঁহু। বাবাকে আমি কোনো কাজ করতে বলতে পারি না। হাজার হ’লেও আমার বাবা।
- তা পারবে কেনো। আজকে যদি আমার বাবা হ’তো তাহলেতো তোমার মুখেই এই কথাগুলো শুনতে হ’তো।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বাবার কানে যে একেবারে যেতো না এই কথাগুলো তা না। নিজেই লজ্জায় লাল হ’তো হয়তো বাবা। হয়তো ছেলের আশ্রিত হিসেবে থাকলে এসব মেনে নিয়েই চলতে হ’বে ভাবতো।

লোকটার দোকানে অন্যান্য বাবারা আসতেন। তাদের মুখে নানা কথা শুনতো সে। দুঃখের কথা- ছেলে হয়তো বাবার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
কিংবা সুখের কথা- বাবা না চাইতেই ছেলে বাবার জন্য এটা করেছে ওটা করেছে।
শুনতো আর ভিতরে ভিতরে আরো নিঃসঙ্গ হয়ে উঠতো লোকটা। নিজের বাবার কথাও মনে পড়তো হয়তো তার।

মফস্বলের সরু রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া ছেলেটা। ভোর বেলা স্কুলে যাবার পথে পুকুরটা। যেখানে মাছেরা প্রত্যহিক অক্সিজেন নেবার জন্য আসতো। মাঝে মাঝে স্মৃতিগুলো খুব জ্বালিয়ে বেড়ায়। বাবা তাকে কখনও মারে নি, যেখানে অন্য বন্ধুদের বাবার হাতে মার খাওয়া ছিলো স্কুলের রুটিনের মতো। একবার, শুধুমাত্র একবার বাবা তার কান ধরেছিলো। তারপর বাবার সেকি কান্না। অপরাধটা সেই বয়সে আর যাপিত জীবনে বেশ ভয়াবহই ছিলো। প্রতিদিন যেখানে স্কুল ছুটি হবার ঘন্টা খানেকের ভিতরই বাসায় ফিরতো সে, সেখানে সেদিন কি ভুত মাথায় চেপেছিলো দু’ আড়াই ঘন্টা বন্ধুদের সাথে স্কুলের পাশের মাঠে খেলা ধুলা করে বাসায় ফিরেছিলো। এই অপরাধটাও আসলে বড় কিছু ছিলো না, বড় ছিলো দেরী হবার কারণ হিসেবে মিথ্যে গল্পটা তৈরী করা। বাবা চুপি চুপি গিয়ে দেখে এসেছিলো তাকে।

একটা সাইকেলের খুব বেশি শখ ছিলো ছেলেটার, কিন্তু সামর্থ ছিলো না। সেটা সে বুঝেও গিয়েছিলো ঐ বয়সেই। তাই বাবার কাছে কখনও আবদারও করে নি। শুধু রাস্তার পাশে যেখানটায় চোরাই অথবা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল গুলো বিক্রি হ’তো সেখানে গিয়ে মাঝে মাঝে সাইকেল নেড়েচেড়ে দেখাটা তার অন্যতম একটা দায়িত্ব হয়ে গিয়েছিলো।

বাবার নিজ হাতে লেখা আত্মহত্যার নোটটা দেখে ছেলেটার মনের সৈকতে একে একে এসে আছড়ে পড়ছিলো স্মৃতির ঢেউগুলো। চোখের কোনায় জমা হচ্ছিলো সাগরের নোনা পানি।

(কাদামাটিতে লেখা হয় গান)

রোদ পুকুরে ঘাঁই দেয় ছায়ামাছ, খোঁজে জোছনার ডিম।

রাত বিছানায় বাৎসায়ন অভিনয়, সূর্য্য ও চাঁদের
শৃঙার নিসৃত শঙ্খবায়ু
আর
মৃত বৃক্ষের যোনীতে ঘর বাঁধা
শুকরের হাড়,
সুর তোলে বাঁশিতে
প্রলম্বিত কোমল গান্ধার।

গানগুলো লেখা হয় কাদামাটিতে, সাপের চলন।

হাতুড়ে মুক্তগদ্য (দু'টো সাপ)...

*
একা সিঁড়ি ঝুলে থাকে সিঁড়িঘর জুড়ে। একপ্রান্ত অন্ধকারে ডুবে গিয়েছে, আরেক প্রান্ত হারিয়ে গিয়েছে মেঘের ভিতরে। দু'টো সাপ (শংখচুড় এবং লাউডগা) আটকা পড়েছিলো মাঝামাঝি কিছু ধাপে। তাদের নরম মেরুদন্ড ভেঙ্গে ক্লান্তি জেগেছে। আর ঘাম জমে পিচ্ছিল হচ্ছিলো বিবিধ প্রথা।

**

লোকেরা কথা বলে এবং সামজিকতা রক্ষা করে চলে অনুষ্ঠানে। বদলে চলে এক বা একাধিক মুখোশ। চোখে চকচক করে কাম, ঠোঁট প্রসারিত হয় লোভের ছোঁয়ায়। কথারা কালনাগ ফণা তুলে প্রস্তুত, ছোবলে সংক্রমিত করবে লালসা। ঘিনঘিনে শরীর নিয়ে লোকেরা ফিরে আসে নিজ নিজ কোনে। দু'টো সাপ রয়ে যায়।

***

ঘরের কোনাগুলোই সবচে অবহেলিত। যখন আগুন লাগে, কেউ সেটা খেয়াল করে না। কোনায় পুঞ্জীভুত ময়লার ভেতর থেকে এক এক করে বের হয়ে আসে ধোঁয়ার বিভিন্ন ভাঁজ। ঘ্রানগ্রন্থিতে সাড়া জাগায় কিন্তু উত্তেজনা জাগিয়ে তোলে না। চুপিচুপি বেড়ে চলে আগুনের সাপ।

(এলোমেলো এলোমেলো)

মাছ জেগে ওঠে ঘুমের অতল সমুদ্র থেকে।

একাকী লালরঙা পোস্টবক্সে এখন আর কেউ চিঠি ফেলে না। হলুদ খাম। ভিতরে নানা শব্দ দিয়ে তৈরী দৃশ্য ও দৃশ্যকল্প। ডিকশনারী কিংবা গল্পসমগ্র'র পাতার মাঝে রাখা শুকনো গোলাপ ও গাছের পাতা। থরোথরো বুক। একটু থমকে থমকে ঠোঁটের পাশ থেকে আলতো ছোঁয়ায় সরিয়ে দেয়া পথজাত ধুলিকণা। মসৃণ ত্বক। শ্যামল গালের উপর মসৃণতাকে আরো উপভোগ্য করে তোলা লালচে আর কালচে এক-দু'টো শারীরিক উপজাত। কিউমুলাস মেঘ চুল। থোকা থোকা এলোমেলো পড়ে থাকা দৈনিক সুষমা ভরা কপালের প্রান্তে। কাজল দানী। সর্ষে তেলে পলতে ডুবিয়ে জমিয়ে নেয়া আগুনের ছায়া। স্টেশন নং নয়। চতুর্থ প্লাটফর্মে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়ানো দিনের পঞ্চম ট্রেন। কলাবতী ফুলের হলুদ। ট্রেনের ছাদ বেয়ে নেমে আসা রোদের সাথে লুকোচুরি লুকোচুরি খেলে ক্লান্ত হয় না। লোহাগন্ধী পানি। টিউবঅয়েলের শ্যাঁওলা-পিচ্ছিল মেঝেতে পড়ে ছলকে ছলকে ওঠা মুক্তির আনন্দে।

হাতুড়ে গদ্য- (স্বপ্ন | রঙীন | অন্ধকার)

স্পষ্টতঃই তামা তাপ ও বিদ্যুৎ সুপরিবাহী...

বিজ্ঞান বইয়ে কথাটা দেখেছিলো। তাই শামায়লা যখনই নিজেকে নিয়ে ধ্বংসাত্মক কিছু চিন্তা করে তখনই চোখে ভেসে ওঠে লাইনটা।

দুপুরের বিষণ্ণতায় বসে হাতে একঝাঁক রোদ নিয়ে তাতে স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে ছিলো সিকান্দ। তাকিয়ে ছিলো বললে ভুল হবে, সে আসলে গভীর ভাবে দেখছিলো স্বপ্নগুলো কিভাবে রোদের স্পর্শে বেনীআসহকলা রঙ ছড়িয়ে দেয়। শরীর ও মনের ভিতরে। কিংবা আশেপাশের পরিবেশে।

শামায়লা ঝাঁ চকচকে বিকেলের উদ্দাম রোদকে ফাঁকি দিয়ে নিজের বিছানায় বসে তাকিয়েছিলো ঘরের কৃত্রিম অন্ধকারের দিকে। চোখের পরতে পরতে জমিয়ে নিচ্ছিলো উন্মনা ভাবনাগুলোকে। এগুলোকেই সে খেলনা হিসেবে সাজিয়ে নেবে অঘুমো রাতের আনাচে কানাচে। পাশের টেবিলে দু'গ্লাস পানি। যার ভিতরে সে ভিজিয়ে নিচ্ছিলো মনের অন্ধকারটাকে।

যে স্বপ্নগুলো চুপটি করে রঙ ছড়াচ্ছিলো এতক্ষণ, তাদের ভিতর থেকে কালো কালো ছায়া উঁকি দিতে দেখে ভুরু খানিকটা কুঁচকে ওঠে সিকান্দ’র। এমন তো হয়নি কখনও। তবে কি তার দুপুর হরিয়ে যাবার পাঁয়তারা করছে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে? ভাবতে ভাবতে সিকান্দ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ভুরু দু'টো আরো বেশি কুঁচকে উঠতে থাকে তার। চোখে এসে জমা হ'তে থাকে রাগ।

বামের গ্লাসটা থেকে এইমাত্র তিনটা ভাবনা তুলে খানিকটা হকচকিয়ে গেলো শামায়লা। কখনও তো এমন হয়নি। পানিতে ডুবে থাকা অন্ধকারগুলো, সময় বয়ে যাবার সাথে সাথে আরো অন্ধকার হয়েছে; এমনই দেখে এসেছে সে সবসময়। কিন্তু এবারের অন্ধকারটা কেমন জেনো ফিকে লাগছে। কেমন জেনো রঙ এর ছোপ দেখা যাচ্ছে। চোখের কোনাটা কুঁচকে আসে শামায়লার। ডানের গ্লাস থেকে আরো কিছু অন্ধকার হাতে নিয়ে নির্বাক বসে থাকে সে। চোখের কোনে জমা হতে থাকে বিষাদ।

সিকান্দ’র স্বপ্নগুলো আরো বিবর্ণ হয়েছে। আরো রঙীন হয়েছে শামায়লার গ্লাসের অন্ধকারগুলো।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা; সন্ধ্যা চুপিচুপি চলে এসেছে রাতের গভীরে। আমাদের সিকান্দ আর শামায়লার ঘরে অনেক তামার তৈরী তার জমা রয়েছে।

মাতৃত্ব আর পিতৃত্ব। শব্দ দু'টো সময় আর পারিপার্শ্বিকতার বিচারে ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতির জন্ম দেয়।

সিকান্দ গত পরশু ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলো। শব্দটা তার জন্য রঙীন কোনো স্বপ্ন নিয়ে আসেনি। যেটাকে সে হাতের তালুতে নিয়ে রোদের আলোয় বেনীআসহকলা নাচের ছন্দে দেখতে পারে।

মাতৃত্ব শব্দটা শামায়লার শরীর মনে বিচিত্র কিছু অন্ধকার জন্ম দিতে পারতো। কিন্তু সেটা হয়নি। কিছু অন্ধকার কিছু রঙ নিয়ে শব্দটা তার শরীর মনে যায়গা করে নিচ্ছিলো গত সপ্তাহ থেকেই।

তামার তৈরী একটা ব্রেসলেটের সাথে যখন সিকান্দ তামার তারটাকে পেঁচিয়ে নিচ্ছিলো, তখনও তার হাতের তালুতে রাখা স্বপ্নগুলোর রঙ অন্ধকারের দিকে চলে যচ্ছিলো।বিদ্যুৎ ও তাপ সুপরিবাহী তামার তার দিয়ে বিদ্যুৎ পরিবহনের মধ্য দিয়ে অন্ধকার থেকে স্বপ্নগুলোর আগের রঙ ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ছিলো সে। বিদ্যুৎ যখন বাধাহীন ভাবে তামার ব্রেসলেট বেয়ে তার শরীরে আসছিলো তখন তার স্বপ্নগুলো আরো অন্ধকার হ'য়ে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়েছিলো।

শামায়লা তার মনের রঙীন অন্ধকারকে পূর্ণ অন্ধকারে ফিরিয়ে আনার জন্য মুখের ভিতর বিদ্যুৎ ও তাপ সুপরিবাহী তামার তার ঢুকিয়ে নিয়েছিলো।

(মেঘদল, বৃক্ষশাবক ও হিমগ্ন দেয়াল)

টুপটাপ ঝরে পড়া রোদের ফোঁটাগুলো একেএকে জমা হয় গ্লাসের কানায় কানায়
এখানে ছেলেরা ঘণহয়েবসে নিষিদ্ধ আকর্ষণের মহরতে
অলৌকিক দরজার উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে কামবালকদের কলোচ্ছল আলাপন

মিস্টি মৃত্তিকা স্বাদে
কষ্টকল্পিত রাত
চাঁদের ছিদ্র দিয়ে চলে যায় সকালের খুব কাছাকাছি

তোমরা ও আমরা একত্রে শুই কিংবা জেগে থাকি
আর আমাদের চোখ নিসৃতঃ সমুদ্রমন্থনের গরল
ভাসিয়ে নিয়ে যায়

মেঘদল

বৃক্ষশাবক

ও হিমগ্ন দেয়াল

...

গতকাল, কিছু গলিত লাশের জিহ্বায় জেগে উঠবে গোধুলী
এমনই লিখা ছিলো দেয়ালিকার সকল পাতায়।

(বিছিন্নপংক্তিমালা-৩)

দাগ মুছে ফেলি, খাতা কিংবা মন থেকে। হাতপাসারাশরীর ধুয়েফেলি সুগন্ধি সাবানের ফেনায়। শাওয়ারের জলধারা নীপবনে পৌঁছে না। জীবাণুমুক্ততার আশ্বাস নিয়ে ফিরে ফিরে আসে রমণব্যাধি। শারীরিক উষ্ণায়নে গলেনা মনপৃথিবীর উত্তরমেরু নির্ভর হিমবাহ। কথা... অনেক কিছুরই সমার্থ নিয়ে তৈরী হয়। তুমি এসে বসো পাশে।



___________________________________________

একটু অস্থিরতানির্ভর এক্সপেরিমেন্ট। শুরু থেকেও পড়তে পারেন, শেষ থেকেও শুরু করতে পারেন।

***

*
পুকুর আর নদীর সামঞ্জস্য পাওয়া সম্ভব কেবল তখনই, যখন নিমজ্জমান স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে জলভরা চোখে। দু' ভুরুর মাঝে যে ফাঁকা যায়গাটা সেখানে জমা হয় বয়সের উল্লম্ব আর আনুভমিক চিত্রকলা। প্রচন্ড দুপুর রোদে যে অলীক নিয়মে বাতাসেরা কেঁপে কেঁপে উঠে যায় পিচগলা রাস্তার মায়া ছেড়ে, সেই একই নিয়ম মেনে চলে জরাগ্রস্ত শরীর।

**
টোনা যে কেবল টুনির সঙ্গ কামনা করে সেরকমটা ভাবা ঠিক না। এক টোনা আরেক টোনার প্রেমময় সঙ্গও কামনা করে অগ্রন্থিত অতীত থেকেই। শুধুমাত্র সঠিক প্রচারণার অভাবেই টোনা-টোনা সম্পর্ককে ভাবা হয় আধুনিকতার বাইপ্রডাক্ট।

***
আঁকাবাঁকা পথের শেষে সবাই আশা করে বেশ আয়েশ টায়েশ করে বিশ্রাম নেয়া যাবে। জলভরা গ্লাস হাতে অপেক্ষায় থাকবে স্নিগ্ধ ঠোঁটের কোন নারী। আঁচলের আলতো ছোঁয়ায় মুছে দেবে সকল ক্লান্তিছাপ। আমি একা থাকতে ভালোবাসি, আঁকাবাঁকা পথের শেষে নতুন আরো পথ খুজে বেড়াই।

হাতুড়ে মুক্তগদ্য...

*
একদিন সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাবো ছাদে। একরাশ রোদের গন্ধ হাতে নিয়ে। চোখে থাকবে বিলম্বিত লয়ের স্বপ্নরাগ। এলোমেলো জীবন পথের মোড়ে মিলে যাবে অনাঘ্রাত সময়। আর তুমি ফিরে যাবে আন্তঃনগর ট্রেনের আঁকাবাঁকা ট্র্যাকে।

**
ক্রিমাটোরিয়ামে লাশের ট্রে'তে ঘন হয়ে জমে থাকে অশউইৎজের শিশুরা। কালো মেঘের সন্ধ্যায় রোদফুলের নৈবেদ্য নিয়ে রাতের তারারা জড়ো হয় আঁধার পোশাকে। বিবস্ত্র চাঁদের রূপসুধায় মাতাল আমরা কিছু যুবক, হেঁটে চলি এ্যসফল্ট নদীর কোল ঘেঁষে।
গন্তব্য? অজানা।

***
বালুঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা থাকেনা কেনো?
উত্তরটা জানা থাকা সত্ত্বেও বলা উচিত হবেনা, কারণ তাতে সাময়িক মানসিক বৈকল্যের প্রমাণ থাকতে পারে। বৃষ্টি জলের ফোঁটায় রক্তছাপ নিয়ে ছুটে চলা বুলেটগুলো আশ্রয় পায় অপরাধী নিরাপরাধ মানুষের পিঠে কিংবা মাথার পেছনে।

****
দু' টাকা পঞ্চাশ পয়সা না তিন টাকা না পাঁচ টাকা দিয়ে নিয়মিত মৃত্যু কেনার যৌক্তিকতা কতখানি, যেখানে জানা আছে সকল মূল্যমানের মৃত্যুই শেষ বেলায় একই ফল দেয় মানুষের চোখে নাহয় মনে।

*****
সবুজ আকাশ আর বেগুনী সাগরের সঙ্গমে যে শিশুটা জন্ম নেবে তার শরীর রক্তের মতো লাল হবারই কথা ছিলো। কিন্তু আকাশ আর সাগরের ভিতর প্রেম হয় নি। তাই বেদনায় আকাশ নীল, সাথে নীল সাগরও। নদী এদিক থেকে অনেক ভাগ্যবতী, সে তার প্রেমিক হিসেবে মাটিকেই চেয়েছিলো। আর তাদের শিশুরা বাদামী আর সবুজে সাজানো।

******
বিপ্রতীপ পুকুরে মীনচক্ষু ছেলের লাশ ভাসে। ঠোঁট ভরা হাসি নিয়ে দা হাতে ঘুরে বেড়ায় ব্রহ্মদত্যি। রোমশ বুকে ঘর তোলে সোনালী ধানের কৃষক। শেষে গোলাভরা ধান বিক্রি হয় শহরের ঝলমলে আলোজ্বলা দোকানে, আর মফস্বলে।

*******
তিনি বলছিলেন "The way you are looking into this matter, is not the right perspective"।
সে মনে মনে বলছিলো "ছড়ি যখন আপনার হাতে..."
নেট ফলাফলঃ- তিনি উঠে আসলেন রুম থেকে, আর সে কিছুটা বিষণ্ণ।

********
লাল রক্ত বয়ে চলেছে বুকে। তুমি ফিরে এসোনা। এখানে এখন আগুনের হাতছানি। একবার পুড়িয়েছি, আর চাইনা পুড়াতে কাদামাটিজল। সেখানে বেড়ে উঠবেনা কোনো বৃক্ষ, ঘর বাধবেনা কোনো কালো পাখি।

*********
নয় সংখ্যাটায় ছন্দের কারুকাজ অনেক। একঘেয়ে ছন্দ আমার ভালো লাগেনা। তবু ভালোবেসে যাই ছন্দগন্ধময় নয় সংখ্যাকে...

(জল কেটে যায় জলের দেয়াল)

জলের দেয়ালে ছায়ার বসবাস পরবর্তী সময়ে
অ-গ্রন্থিত কিছু ঘুম খড়িমাটি স্বপ্ন দাগ এঁকে যায়,

সঙ্গম তৃপ্ত নক্ষত্র কিংবা সূর্যেরা, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রগ্রহন
মাপে পান পেয়ালায় চুমু দিয়ে

রংধনুর সুললিত বাঁকে বাঁকে জমা হয় বৃষ্টি বিষাদ।

জলেই কেটে যেতে থাকে একাধিক জলের দেয়াল।









____________________________________________________________
কোনো কারণ ছাড়াই আমার ব্লগ থেকে পাওয়া শেকল ভাঙ্গা বোনটাকে মনে করলাম
লেখাটা দিয়ে

বইয়ের নাম স্মৃতি .:::. চ্যাপ্টারঃ- শিশুকালের ঈদ

স্মৃতির বইটা খুলে শিশুকালের ঈদ লেখা চ্যাপ্টারে ঢুকে একটু নেড়েচেড়ে দেখতে ইচ্ছে হ'লো। কেমন ছিলো তখনকার ঈদের দিন গুলো? কেমন ছিলো ঈদের আগের রাত গুলো???

পৃষ্ঠা উল্টোতে উল্টোতে দেখলাম এক দু'টো স্মৃতি ছাড়া আর সবগুলোতেই সময় বা বয়সের ময়লা জমতে জমতে এমন হয়েছে যে পড়ারই উপায় নেই নইলে টুকরো টুকরো বাক্যাংশ উঁকি দিচ্ছে সর্বগ্রাসী বয়সের থাবা এড়িয়ে...

খুলনায় যখন ছিলাম। ভুলবোনা প্রতি ঈদের আগের সন্ধ্যায় নিউমার্কেটে যাওয়া। আব্বু, আম্মু, দাদু, আমি। কিচ্ছু কেনার জন্য না। কারণ যা যা কেনার আব্বু আম্মু আগেই কিনে এনেছে। আজকের সন্ধ্যাটা শুধু ঘুরবার জন্য। মনে পড়ছে চিস্তীয়া কনফেকশনারীতে থাকা একমাত্র কোন ম্যাশিন থেকে দাদু আর আমাকে দু'টো কোন কিনে দেয়া। কখনো আব্বুর কোলে চড়ে কখনো আম্মুর হাত ধরে গুটু গুটু করে হেঁটে বেড়ানো নিউমার্কেটের এ-প্রান্ত থেকে সে-প্রান্তে।

ক্লান্তি জমতো না তখন। বাসায় এসে হয়তো পাশের বাসায় যেতাম, টিভিতে পুরোনো আনন্দমেলা দেখাতো সেটা দেখতে। হয়তো ঈদের জামা গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া, বারবার করে নাক ডুবিয়ে গন্ধ নেয়া। জুতোটাকেও হয়তো কখনও বুকে জড়িয়ে ধরতাম।
ঈদের কিছুদিন আগে চুপিচুপি ঘুমের ভিতর আব্বু পায়ের মাপ নিতো কাগজে এঁকে।

সেই ঈদের আগের রাতের কথা ভুলবো না, যে রাতে আমরা সন্ধ্যা বিহার সেরে এসেছি নিউমার্কেট থেকে। এরপর পাশের বাসায় টিভি দেখতে গিয়েছি, হঠাৎ নওশাদ এসে বলছে যে শুভ তোমাদের বাসায় টিভি নিয়ে এসেছে। শুনে সব কিছু ফেলে দে দৌড়...
নিক্কন ১৭ ইন্চি সাদাকালো টিভি ছিলো সেটা। "বিমুর্ত এই রাত্রি আমার" গানটা গাইতো আবিদা সুলতানা আর এই টিভিটার এ্যড দিতো। ১৮ বছর আমাদের সাথেই ছিলো টিভিটা।

সেবার ঢাকায় চাচী বাড়িতে ছিলাম। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে থাকতো তখন চাচীরা। আব্বুর সাথে মাঠে গিয়েছি ঈদের নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে মোনাজাতের সময় আব্বুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে আমি ছোট ছোট হাত দিয়ে সেই পানি মুছিয়ে দিচ্ছি। দৃশ্যটা এখনও সময় অসময়ে আমার চোখে ভেসে ওঠে। সেই থেকে এখন পর্যন্ত (নাস্তিক হওয়া সত্ত্বেও) কোনো ঈদের নামাজ আব্বুর সাথে ছাড়া কখনো পড়িনি। কেন জানি মনে হয় হয়তো কোনো ঈদে আবার আব্বু মোনাজাতের সময় কাঁদবে, আর আমি আব্বুর চোখের পানি মুছিয়ে দিবো...

(ওখানে এখন কতো রাত)

দূরবর্তী লাইটহাউজের শেষ আলোর বিন্দুরা যখন মিলিয়ে গেলো
ক্ষয়িষ্ণু ঈদের চাঁদের কোনায়,
তখনই হেসে উঠেছে ওপাড়ার ক্লান্ত শিশুদের ঘুম।

বুভুক্ষু তৃষ্ণায় জাহাজের ঢেউগুলো অবিরাম তাল মিলিয়ে গেছে সিগারেট নিসৃত ধোঁয়ার ছন্দে
কালো বরফের আড়মোড়া ভাঙ্গা ধ্রুবতারাদের সভা চলেছিলো মেষ রাশির অগম্য ক্ষেত্রে।

বৃষ্টি কি হয় ওখানে?
যেখানে সুমেরূ কুমেরূ একাকীত্ব নিয়ে শুয়ে থাকে বিরহের দোলাচলে...

রাতেরা কি গান গায়?
দিবাচর পাখিদের স্বপ্নে কিংবা কৃষ্ণগহ্বরে ঘর বাধা ভিখারীর থলেতে?

দুপুর তিনটা ছয় বেজেছে আমার শরীরে
ওখানে এখন কতো রাত?

(বিছিন্নপংক্তিমালা-২)

শরীর গজিয়ে ওঠে পাথরকুচি হাতের ভাঁজ থেকে, যেখানে,
বিষণ্ণ দুপুরের আয়না পথে হেঁটে বেড়ায় অসমাপ্ত বায়ুসুত্র
আর
আলসে চলনে তৃতীয় পাক্ষিক দ্বন্দ্ব ভেঙ্গে পরে লাজুক ছায়ার আড়ালে
মাঝ পথ থেকে উঠে আসা মরীচিকার স্বপ্ন
ধুলোতেই ঘর বাঁধে আবেগহীন।

(বিছিন্নপংক্তিমালা-১)

বাইরে বসে ভেতরের ডাক শুনতে পাওয়া সম্ভব কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

কেউ কি আসলে নিজে থেকে আসে কিংবা যায়?
বাসে-ট্রেনে-পায়ে হেঁটে...
আদৌ কোথাও যাওয়া যায়?
মন পড়ে থাকে আটপৌড়ে ঘরের কোনায়,
পাহাড়-সাগর-বন কোথাও গিয়েই আসলে যাওয়া হয়ে ওঠে না।

চোখের কালো গভীরতায় যে অসুখের বসবাস
তা কখনোই ভেসে ওঠেনা কনজাংকটিভাইটিস আক্রান্ত সন্ধ্যাকাশে।

(লোভের বসবাস যেখানে)

ওখানে লোভ বসে আছে

ঝাঁ চকচকে ফ্লাটের মেটালিক ডোরনব পেঁচিয়ে আছে লোভের সুতানালী সাপ
গোড়ালী দেবে যাওয়া কার্পেটের বুননে বুননে তার বিষদাঁতের ছোঁয়া
ডাইনিং টেবল এ রাখা সার সার খাবার পাত্রে তার সুক্ষ্ম শরীর ডুবে আছে
মেহগনি কিংবা সেগুনের ওয়ার্ডরোবের কারুকার্য থেকে ঝলকে ওঠে দংশনের আলো।

ওখানে লোভ বসে আছে

লোভের ময়াল সাপ আস্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে ড্রেনের পাশের বস্তিটা
বাঁশের বেড়ার ফাঁক ফোকড় দিয়ে ঢুকছে তার বিষ নিঃশ্বাস
কাদা মাখা পায়ের পরতে পরতে ছোবলের দাগ দেখা যায়
দৈনন্দিন গালাগালি কিংবা মারামারি ক্রমশ টেনে নিয়ে যায় ভিতরে।

(ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদ কিংবা দুপুরেরা)

হাত পেতে ঘুরে ফিরি ভিখিরীর মতো,
ধরে নেবো দু'ফোঁটা রোদ, মাঝ দুপুরের আলস্য মাখা,
শহুরে দরজা-জানালার কোনায় কোনায়;
ধরতে পারিনা কোনো মতেই, উল্লাসে নেচে গেয়ে
রবিরেখা বেয়ে নেমে যায় রোদের ফোঁটারা।

ভাগ্য আর আয়ু রেখার করিডরে গজিয়ে ওঠে ভোরবাহিত শ্যাওলার দল
স্বপ্নের ধুলোখেলা, এলোচুলের আবিষ্ট বিদ্যুতে।

সরল কিংবা বক্র সমাধান লিখে দেবে হীরার নাকছাবি।


আকাশ এবং শহরের চাঁদেরা, এখন লীন হতে চায় জোয়ারেই।

(কিচ্ছু হয়না, কিছুই হয়ে ওঠাও হয়না)

কিচ্ছু হয়না।

কিছুই হয়ে ওঠাও হয় না।

নিয়ত ছুঁড়ে ফেলি নিজেকে, আস্তাকুঁড়ে।

যেখানে

একসাথে জড়াজড়ি করে পড়ে থাকে কনডম, অপরিণত শিশুর মরদেহ, নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিব্যাগ, ফ্রীজের ভেতরে থাকা সত্ত্বেও দুর্গন্ধ ওঠা বাসী তরকারী, কোমল পানীয় বা শক্তি বর্ধক পানীয়ের বোতল, ছিঁড়ে ফেলা কবিতা কিংবা গদ্য খাতার পৃষ্ঠা, মাছের কাটা, মাংসের হাড়।

সেই সাথে

নিতান্ত নিজস্ব অবহেলায়, উঁইয়ে খাওয়া লাল-সবুজ একটা পতাকার খন্ডাবশেষ।

(পৌনঃপুনিক ফিরে আসা মনের কার্নিশে)

কাঠপেন্সিলের শীষ গুলো সারাক্ষণ তীক্ষ্ণ হতে থাকে শার্পনারের চুমুতে
লাল, হলুদ, কালো রঙ এর কাঠের চামড়া জমা হতে থাকে,
নির্জন মনস্তত্ত্বে
সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর হতে থাকে গ্রাফাইটের কেন্দ্র।

গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয় ছায়া, অন্ধকারের রাজত্ব
নগ্ন কনকোরা কাগজের অমসৃণ সমতলে ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের আঁকিবুকি...

লেখা হয় অনিঃশেষ অপারগতার সংলাপ;

পৌনঃপুনিক শরীরী আকর্ষণে ফিরে ফিরে আসা মনের কার্নিশে।

(সুঘ্রাণ, তপ্ত জেগে থাকায়)

হাতের রেখা বেয়ে নেমে আসে অগুনতি দৃষ্টির চোখ
শিরায় বয়ে চলে অসংলগ্ন কথামালাসিক্ত সময়
আদি সাপের, দ্বিধান্বিত জিহ্বার পরশে
রোপন হয় নাভীমূলে জীবন

তপ্ত জেগে থাকা চাদরের সুঘ্রাণে।

(জলের বুকে জলের দাগ)

নগ্ন ঘুন পোকার বাস টেবিলের প্রস্থচ্ছেদ বা লম্বচ্ছেদের আনাচে কানাচে।

বয়সের রংতুলি যে পাক গুলো এঁকে দিয়েছিলো গাছের গুঁড়িতে
তার কোনোটিই আর কোনো ছায়া ফেলে না ডালে বসা মাছরাঙার বর্ণিল পালকে।

মীনচোখ
প্রতিসরিত জল দৃষ্টিতে জাগেনা কোনো রকমের কামজ কিংবা জলজ অনুভুতি।

স্মরণাতীত কালের চেতনা
দাগ কেটে রাখে জল থেকে জলের বুকে...