সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১০

মেরুদন্ডের ভিসকসিটি বা সিঁড়ি বেয়ে উঠার গল্প

আমাদের মেরুদন্ড চা'য়ে ভেজানো এনার্জি প্লাস বিস্কুট হয়ে উঠতে থাকে, আর আমরা দিন দিন বাঁকা হয়ে যাই। আমাদের পায়ের নিচে মাটি অবশ্য শক্তইতথাকে। তার উপর ইট-বালু পড়ে, পিচ কিংবা কংক্রীট ঢালাই হয়। শক্ত মাটিতে আমরা মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। সিঁড়িবাজ মানসুর, আমাদের অর্ধতরল কশেরুকাগুলো দিয়ে তার সিঁড়ির ডেকোরেশন করে। আমরা তখন ঘেসো জমি থেকে কেলে ভুতদের শ্যাওড়া গাছ কেড়ে নিতে ব্যাস্ত থাকি।

কখনো সিঁড়িবাজ মানসুরের সাথে আমাদের দেখা হয়। তখন হয়তো সে সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে। আমরাও তার সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে নামতে থাকি। আমাদের জন্য তার পায়ে তখন অফুরান সময়। তার হাতে যখন চকলেট-ব্রাউন ওয়ালেট বের হয়ে আসে, তখন হয়তোবা আমাদের ঘাড় লম্বা হয়ে ওঠে, ছোবল উদ্যত সাপের মত। উৎসুক চোখগুলো হামলে পড়ে ওয়ালেটের এখানে সেখানে। নিপুন বীণবাদক যেমন বীণের সুরে সাপকে সম্মোহিত করে রাখে, তেমনি ওয়ালেটের দেয়ালে সাজানো বিভিন্ন ব্যাংকের সোনালী বা প্লাটিনাম তৈলচিত্রে আমরাও সম্মোহিত হয়ে পড়ি। আমাদের সহসা কঠিন ভারটেব্রা আবারো অর্ধতরল হয়ে পড়ে।

সিঁড়িবাজ মানসুরের ছুঁড়ে দেয়া উচ্ছিষ্ট নিয়ে আমরা ফিরে আসি শক্ত বা নরম মাটিতে। আর মানসুর মনোযোগ দেয় সিঁড়ি বেয়ে উঠায়। আমরা রাস্তার পাশের পিঠার দোকানে হাঁটুমুড়ে বসি, দোকানীর সাথে আলগা খাতির জমানোর চেষ্টা করি। মরিচ ভর্তা দিয়ে পিঠা খেতে খেতে শব্দ করে শ্বাস নেই। শ্বাসের সাথে মরিচের সব ঝাল টেনে নেই ভিতরে, এই ঝাল আমাদের মেরুদন্ডকে আরো খানিকটা বিষাক্ত করে। গলিত মেরুদন্ডের বিষ নিয়ে আমরা শক্ত মাটিতে দাঁড়াই। ডানপাশের খোলা দেয়ালটার সামনে গিয়ে পেশাব করি। তারপর গভীর রাতের জন্য অপেক্ষা করি। রাতের গভীরতা পর্যাপ্ত ঘণত্বে পৌঁছুলে বাঁয়ের খাল ঘেষা বাঁশের কাঠামোগুলোয় আমাদের মেরুদন্ডীয় বিষ ঢেলে দেই। বিষের কমলা সোনালী রঙ ছড়িয়ে পড়ে সারাটা বামপাশ জুড়ে। আমরা শক্ত মাটির উপর গড়িয়ে গড়িয়ে দুর থেকে আরো দূরে সরে যেতে থাকি।

আমরা বারেকের দোকানে চা খেতে যাই। আমাদের হাতে থাকে এক প্যাকেট এনার্জি প্লাস বিস্কুট। আমরা চা'য়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে তাকিয়ে থাকি বারেকের সাদা-কালো টিভির দিকে। যখন আমাদের বিস্কুটের কথা খেয়াল হয়, ততক্ষণে চা'য়ের কাপের তলায় বিস্কুটটা ঘর-বাড়ি বানিয়ে নিয়েছে। আমরা খুব উৎসাহের সাথে সেই ঘণ চা'তে চুমুক দেই। গলিত, অর্ধতরল বিস্কুটের ভেতর আমরা একটা হলেও শক্ত দানা খুঁজে পেতে চাই।

সিঁড়িবাজ মানসুর যখন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে, তখন তার চোখকে ঘিরে থাকে সানগ্লাস। সেটা এতই গাঢ় রঙের, যে সিঁড়ির সাজসজ্জা তার চোখের কোনো অংশকেই আঘাত করতে পারে না। গাঢ় সানগ্লাস পড়ে সে আমাদের মাড়িয়ে চলে যায়। আমরা তার চকলেট-ব্রাউন ওয়ালেটের তৈলচিত্র দেখতে পাইনা। আমাদের সম্মোহন কেটে যেতে থাকে। আমরা বারেকের দোকানে ফিরে আসি। এইবেলা আমাদের হাতে এনার্জি প্লাসের প্যাকেট থাকে না। আমরা চা'য়ে সস্তার টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে ডুবে যাই সাদা-কালো টিভিতে। যখন বিস্কুটের কথা মনে পড়ে, তখন সমগে স্মৃতি জুড়ে এনার্জি প্লাস। আমরা চা'য়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘণ তরল পাই না, বরংকিচছুটা নরম টোস্ট বিস্কুট আমাদের হাতে রয়ে যায়। অনভ্যস্ত আমরা সেই টোস্ট বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুখে পুরে চিবানোর সময় আমরা টের পাই বিস্কুটের কেন্দ্রে কিছুটা মচমচে ভাব। আমাদের বাঁকা পিঠ খানিকটা সোজা হয়ে অঠে। ওদিকে পিচ কিংবা কংক্রীটের জমিতে ফাটল ধরে।

আমরা আস্তে আস্তে চা'য়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়া ভুলতে থাকি। আমাদের নরম পিঠ দৃঢ় হয়ে উঠতে থাকে। আমরা নরম মাটিতেও খাড়া দাঁড়িয়ে থাকি। সিঁড়িবাজ মানসুরের সাথে পাশে পাশে আমরাও সিঁড়ি বেয়ে উঠা শিখি। আমরা একদল ছেলেকে চা'য়ে এনার্জি প্লাস বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়া শেখাতে থাকি।

সিঁড়িবাজ মানসুর একদিন পা হড়কে সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। তার সিঁড়ির অর্ধতরল সাজে খাদ ঢোকে। আমরা সতর্ক হতে শিখি। সিঁড়িবাজ মানসুরের পরিণতিই আমাদের সতর্ক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আমরা সিঁড়ি বানানো বাদ দিয়ে লিফট তৈরীতে মনোযোগ দেই। যদিও আমরা ভিতরে ভিতরে অনুভব করতে পারি লিফটও আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। আমরা নতুন একদল মানুষ সংগ্রহ করি। যারা চা'য়ে এনার্জি প্লাস বিস্কুট ভিজিয়ে খেলেও সেটাকে অর্ধতরল হতে দেয় না। তাদের দাঁত শক্ত বিস্কুট খাবার উপযোগী। আমরা তাদের পাশে নিয়ে লিফটে ঢুকি। কয়েকতলা পর্যন্ত তারা আমাদের সাথী হয়, তারপর আমাদের সম্মান দেখাতে লিফট থেকে নেমে দাঁড়ায়। আমরা আরো কয়েকতলা উঠে যাই। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের লিফট শ্যাফট জুড়ে অনেক সিঁড়িবাজ মানসুর পড়ে রয়েছে। আমরা নির্লিপ্ত ভাবে কফিতে চুমুক দেই আর এনার্জি প্লাস বিস্কুটের প্যাকেট উড়ে বেড়ায় আমাদের ঘিরে।

অশিরোনাম পংক্তিমালা

.
.

ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে সেই সকাল থেকে।

তিনটা কাক,
একটা শালিক
আর পাঁচটা চড়ুই
বসে আছে কার্ণিশে।

হুশ, বলতেই উড়ে গেলো মেঘেরা।

কেউ কি আমাকে একটু সূর্যোদয় ধার দেবে?
বুকপকেটে রাখা চিঠির সাথে গেঁথে দিতাম...