এপ্রিল ১৮, ২০১১ - ১:০৬ পূর্বাহ্ন
অনেক রাত। প্রায় আড়াইটা তিনটা হবে। পরিশ্রান্ত নায়ক গভীর ঘুমের রাজ্যে।
উনি শুধু এই গল্পেরই নায়ক নন, উনি টিভি বা চলচ্চিত্রেরও নামকরা একজন
অভিনেতা। তার বেড সাইড টেবিলে রাখা ফোন গুলোর একটা বেশ সুরেলা ভাবে গেয়ে
উঠলো। রাতের শীতল নীরবতায় সুরেলা শব্দটাকে কর্কশ শোনালো। ঘুম ঘুম চোখে নায়ক
ফোনটা হাতে নিলেন। কলারের নামটা দেখে নিমেষেই চোখ থেকে ঘুম ঘুম ভাবটা দূর
হয়ে গেলো। শরীর ঢেকে রাখা কম্বলটা সরিয়ে তিনি সন্তর্পনে নেমে আসলেন বিছানা
থেকে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা গাউনটাকে জড়িয়ে চলে আসলেন পাশের ঘরে। আবছা আলোতে
ঢেকে থাকা সোফাটাকে এড়িয়ে গেলেন বেড়ালের মত।
রিসিভ বাটনে চাপ দিতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো নায়লার অস্থির কণ্ঠ-
- হ্যালো। হ্যালো। কি হলো, কথা বলছো না কেনো? হ্যালো?
= কি হয়েছে জান? এখন কয়টা বাজে খেয়াল করেছো?
- কিজানি কয়টা বাজে, তুমি কি করছিলে? ঘুমাচ্ছিলে?
= অন্য কি করবো? তুমি কি পাশে আছো?
- যাও। সবসময় ফাজলামি
= কি হয়েছে বলতো? তোমার গলা কেমন অন্য রকম লাগছে।
নায়ক নিজের অভিনেতাসুলভ আচরণ এবং শব্দচয়নে মন দিলেন।
- কি হয়নি তাই বলো? ফারুক এসে উপস্থিত হয়েছে।
= ফারুক?
গলায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিস্ময় ঢেলে নায়কের প্রশ্ন।
= ও কিভাবে তোমার ঠিকানা পেলো?
এবার বিস্ময়ের সাথে উৎকণ্ঠা যোগ করা হলো।
- কিভাবে পেলো সেটা আমি কোত্থেকে জানবো? শুধু জানি রাত একটার সময়
কলবেলের শব্দ শুনে, তুমি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে এসেছো ভেবে দরজা খুলে দিয়ে
দেখি ফারুক দাঁড়িয়ে। দাঁড়িয়ে বলা ভুল হবে, ও আসলে টলছিলো। মুখ থেকে ভুরভুর
করে বেরোনো মদের গন্ধ নিয়ে টলছিলো।
= বলো কি?
- প্রথমেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুঁকে গেলো। তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে
কান্না। আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না। আবোল তাবোল। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে
এসেছে, আরো কত কি বলছিলো।
= তারপর?
- তারপর আর কি? যখন আমি বললাম যে ওকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। শুনে খেপে উঠলো। তারপর শুরু করলো আমাকে মারা।
= কি বলো? তোমার গায়ে হাত তুলেছে? এতবড় সাহস ওর?
কিছুটা উষ্মা যোগ হলো নায়কের কণ্ঠে।
- হু। মেরে কালশিটে ফেলে দিয়েছে।
= এখন? এখন কি করছে সে?
- হাতের সুখ মিটিয়ে এখন জ্ঞান হারিয়ে শুয়ে আছে মেঝেতে। আমি এখন কি করবো? যার ভয়ে শহরের এই মাথা থেকে ঐ মাথায় চলে আসলাম, তাই হ’লো।
নায়কের মাথার ভেতরের কলকব্জা গুলো পুরোদমে চালু হয়ে গেলো। সে যখন
পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করতো তখন নায়লার সাথে পরিচয়। নায়লার ক্যারিয়ার তখন
একেবারে মাঝ আকাশে। এই মেয়েটাকে জড়িয়েই তার নায়ক হিসেবে উত্থান। এই মেয়েটার
সাহায্য না পেলে হয়তো তাকে এখনও পার্শ্বচরিত্রাভিনেতা হিসেবেই থেকে যেতে
হ’ত। মেয়েটা যেমন তাকে সাহায্য করেছে উপরে উঠে আসতে তেমনই দেহমন উজাড় করে
ভালওবেসেছে। কিন্তু তাকে সাহায্য করতে গিয়ে মেয়েটার নিজের ক্যারিয়ারে
লেগেছে ভাটার টান, সংসারে জ্বলেছে আগুন। তারপরও সে নায়কের পাশে থেকেছে। এখন
মেয়েটার ভয়াবহতম দুঃসময়ে তারে পাশে থাকা তো নৈতিক কর্তব্য।
- এই কি হ’ল? কিছু বলছো না যে?
= নাহ। আমি আসলে ভাবছিলাম কি করা যায়। আসলে কি করা উচিত।
- কিছু পেলে?
= পেয়েছি। কিন্তু তোমাকে বলতে ভয় হচ্ছে। তুমি মনেহয় আমার কথামত কাজ করতে পারবে না।
- বলেই দেখোনা। তোমার জন্য আমি সব করতে পারি স-অ-ব।
= তুমি কি পারবে ফারুকের মুখের উপর একটা বালিশ চেপে ধরতে? তাহলে সারা জীবনের জন্য আমাদের পথের কাঁটা দূর হয়ে যাবে।
- কি বলছো এসব?
= আগেই বলেছিলাম পারবে না, আমাদের মনেহয় এভাবেই দূরে দূরে থাকতে হবে।
এবার নায়কের গলার স্বর থেকে বেদনা গলে গলে পড়লো।
- না। এভাবে বলোনা। তোমাকে না পেলে আমি মরেই যাবো।
= কিন্তু ফারুক বেঁচে থাকতে সেটা কি সম্ভব? কখনই সম্ভব না।
নায়কের গলা প্রায় কাঁদো কাঁদো।
- কিন্তু...
= এই দেখো, এখনও তুমি নিজের মনকে স্থির করতে পারছো না।
- আমার হাত কাঁপছে তোমার কথা শুনেই।
= থাক তাহলে।
নায়কের গলায় হতাশার সুর বাজলো।
- না...না... তুমি বলো কিভাবে কি করতে হবে।
= তোমার বিছানা থেকে বালিশটা তুলে নিয়ে গিয়ে ফারুকের মুখের উপর চেপে ধরো। মাত্র পাঁচ মিনিট। ব্যাস।
- কিন্তু... তুমি কি এরপর আমাকে আগের মত ভালবাসবে?
= কেন বাসবো না? আমি তো তোমার সাথেই আছি। আগেও ছিলাম, এখন এই কাজের সময়েও আছি।
নায়কের গলায় এবার ভালোবাসার বন্যা।
- এরপর ফারুকের লাশটা নিয়ে কি করবো বললে না যে?
= কম্বল দিয়ে লাশটা মুড়িয়ে তোমার গাড়িটায় তুলবে। তারপর গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে
যাবে পূর্বাচলের দিকে। ওখানকার ব্রিজটার উপর থেকে লাশটাকে নদীতে ফেলে দেবে।
তারপর বাসায় চলে এসে সব কিছু ভুলে যাবে।
- আমি পারবো না। আমার হাত পা সব কাঁপছে।
= ঠিক আছে তাহলে, আমার কথা ভুলে যাও।
- না, না। আমি পারবো। আমাকে পারতেই হবে।
= এইতো লক্ষী মেয়ে। যাও আমি ফোন ধরে আছি।
এক দুই তিন চার এভাবে পাঁচ মিনিট পার হয়ে গেলো। এই সময়ে নায়কের চেহারায় নানা রকম অনুভূতি তাদের ছাপ রেখে গেলো।
- হয়ে গেছে জান।
= তুমি আমার ঐ ফোনটাতে একটা রিং দাও। এটার চার্জ প্রায় শেষ।
নায়কের দ্বিতীয় ফোন এবার বেজে উঠলো। এবার নায়ক আগেই সেটার রিংগার অফ করে রেখেছিলেন।
- আমি... আমি ফারুককে মেরে ফেলেছি।
= এবার কি করবে?
- এবার লাশটাকে কম্বলে মুড়িয়ে গাড়িতে করে পুর্বাচলের ব্রিজের কাছে ফেলে আসবো।
= ভোর কিন্তু হয়ে আসছে।
- হ্যাঁ হ্যাঁ আমি যাচ্ছি।
= আমি ফার্স্ট ফ্লাইটেই চলে আসবো।
নায়ক এবার আরেকটা নাম্বারে ডায়াল করলেন।
= হ্যালো। গুলশান থানা? ওসি সাহেব বলছেন?
_ জ্বি বলছি।
= দেখুন আমি অভিনেতা মাহির হুসাম বলছি। কিছুক্ষণ আগে আমাকে আমার বন্ধু
ফারুক এর স্ত্রী ফোন করেছিলেন। উনি বলছিলেন উনি নাকি আমার বন্ধু ফারুক কে
খুন করেছেন। এখন নাকি নিজের গাড়িতে করে তার লাশ ফেলতে যাচ্ছেন পুর্বাচল
ব্রিজের ওখানে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমি ব্যাপারটা আপনাকে জানানো
কর্তব্য মনে করছি।
_ ঠিকাছে স্যার, আমি ব্যাপারটা দেখছি। আপনি আমাকে শুধু বাসার ঠিকানাটা বলুন।
অনেক দিনতো নায়লার সাথে কাটলো। এবার তার এগিয়ে যাবার পালা, কে পুরোনো গ্ল্যামারলেস নায়িকার সাথে বাকি জীবন কাটাবে?
নায়ক কথা শেষ করে আগের সেট থেকে সিম বের করে ভেঙ্গে ফেলে বাথরুমে গিয়ে
ফ্ল্যাশ করে দিলেন। তারপরে শোবার ঘরে ফিরে গাউন খুলে আবার কম্বলের তলে ঢুকে
পরলেন।
পাশ থেকে মেয়েটা জিজ্ঞাসা করলো “কে ছিলো মেয়েটা?”
নায়ক বললেন “মেয়ে না তো, এক প্রযোজক। উনার সাথে একটা সিনেমার ডিল পাকা করলাম”।
মেয়েটা মৃদু হাসির সাথে বললো “এই না, না। ওখানে না। যাহ।”
ধীরে ধীরে দুজনের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসলো।