অস্তগামী চাঁদের সাদা জোছনা ছড়িয়ে পড়ে সবুজ চাদরে/ আলো অন্ধকার আটকা পড়ে মীনচোখ বৃত্তে/ মাৎসন্যায় ঘটে যায় রক্তমাখা তীর সঞ্চালনে/ সবাই বন্দী রয় বৃত্তে...
মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০১৩
স্মৃতির নরোম রোদমাখা গলিপথে
মে ৩১, ২০১১ - ১১:৫৩ পূর্বাহ্ন
গত পনের দিন যাবত অফিসে উদভ্রান্ত কাজের চাপ যাচ্ছে। বেশ ভালই দৌড়ের উপরে আছি। কাজের চাপ বা দৌড়ের উপর থাকাটা উপভোগই করি মোটামুটি। আবার মাঝে মাঝে মন বিদ্রোহ করে বসে, তখন মনকে সুস্থির করার জন্য কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ঘুরে বেড়াই স্মৃতির রাজপথ থেকে গলিপথে গলিপথে।
শিশুবেলার স্মৃতির গলিটা মাখামাখি করে আছে সকালের নরোম রোদে। গলির দু'পাশে সারি সারি দাঁড়ানো ঘর গুলোর জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে এই স্মৃতি ওই স্মৃতি আমাকে ডেকে চলে। আমি আনন্দিত হই। আমার রক্তে কাঁপন ওঠে শিশুবেলার স্মৃতিদের দেখতে পেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই গলির প্রায় শেষ মাথার একটা ঘরে। যেখানে আমার অনেক পুরোনো স্মৃতিগুলোর বসবাস। এই ঘরটার অনেক বাসিন্দাই চলে গেছে সময়ের সঙ্গী হয়ে, আবার কেউ কেউ রয়ে গেছে আমারই মায়ায়।
তাদের ভেতর থেকেই খুঁজে পাওয়া কিছু স্মৃতির সাথে...
*
কেজিতে পরতাম। বাসায় আব্বু মাঝে মাঝে গুন গুন করে গাইতো
"বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের এই বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রুপসী বাংলা রূপের যে তার নাইকো শেষ"
শুধু এই লাইনটাই। আমি কখনো যদি এর পরের লাইন গুলো শুনতে চাইতাম, আব্বুর স্বর আরো নিচু হয়ে যেতো। আব্বু বলতো এখন এই গান গাওয়া ঠিক না, তোমার এখন এই গান শেখার দরকার নেই। বিস্নিত হতাম, কৌতুহলী হতাম, কিন্তু কৌতুহল চাপা দিয়ে রাখতাম।
*
আমার দাদু, মানে আমার বড় বোনের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছয় বছরের। কিন্তু সেটার কোনো ছায়া আমাদের দু'জনের দুষ্টুমিতে বাধা হয়নি। ছুটির দিন আমাদের প্রায় অবধারিত খেলা ছিলো বাসার বারান্দায় পানি ঢেলে পিছলা পিছলা খেলা। কখোনো সেই পানির সাথে যোগ হ'তো জেট ডিটারজেন্ট পাউডার, আরো বেশি পিচ্ছিল হয়ে উঠতো বারান্দা। আরো বেশি উচ্ছাস আনন্দ যোগ হ'তো আমাদের খেলায়।
*
একবার প্রচুর বৃষ্টিতে বাসার উঠোন, পাশের বাসার শিরিন আন্টিদের জঙ্গল টাইপের বাগানে হাঁটু পানি জমে গেলো। সন্ধ্যার মুখোমুখি সময়, আম্মু তখনো ভাতঘুম থেকে ওঠেনি। আমি আর দাদু একটা গামছা নিয়ে নেমে পড়লাম সেই পানিতে। মিশন মাছধরা। যদিও মাছ কোত্থেকে আসবে সেই ধারনা নেই। মাছ ধরার আশায় আশায় চলে গেলাম শিরিন আন্টিদের বাগানে। শেষ অব্দি মনেহয় দুইটা না তিনটা পুঁটি মাছ পেয়েছিলাম। বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পার। আম্মু এদিকে রেগে অগ্নিগিরি। মার পড়েনি পিঠে, তবে নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে বিকেলের দুধ বিস্কুট থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম।
*
বাসায় কয়েকটা মুরগী পালা হ'তো। একদিন দাদু দুইহাত মুঠ করে নিয়ে এসে আমাকে বলছে দেখ দেখ কি নরোম। আমি দেখি যে দাদুর হাতের মুঠোয় একটা ডিম, আর কি আশ্চর্য!!! ডিমের খোলসটা আসলেই নরোম। একটু পর দাদুর কাছ থেকে সবিস্তারে জানতে পারলাম যে কিছুক্ষণ আগে, আমাদের কালো মুরগীটা ঠিক দাদুর সামনেই ডিম পেড়েছে। দাদু সেটা তুলতে গিয়ে টের পেয়েছে যে এট তুলোর মতো নরোম।
*
বাসায় যখন দাদু আর এলাকার মেয়েরা মিলে রান্না-বাটি খেলতো, নিশ্চিত ভাবে আমি বাজার সরকারের দায়িত্বটা পেতাম। আমারই সমবয়েসী ছেলেদের কেউ পেত বাসার চাকরের দায়িত্ব, কেউ পেত কোনো একজনের বাচ্চা হবার দায়িত্ব। এরকমই একদিন বাজার সরকারগিরি করছি, মাথায় কি ভুত চাপলো বাজারের ব্যাগ হাতে ঢুকে গেলাম আমাদের স্টোর-রুমে। সেখানে একটা পুরোনো টেবিল ল্যাম্প ছিলো, যেটার বাল্ব লাগানো ছিলোনা। আমি আধুনিক শপিংয়ের আনন্দে টেবিল ল্যাম্পের সুইচ অন করে হোল্ডারের ভিতরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়েছি, খেয়াল আর করি নি যে ল্যাম্পের পাওয়ার কানেকশন দেয়া আছে। তো, আঙ্গুল হোল্ডারের ভেতর দেবার সাথে সাথেই হোল্ডার আমাকে আকর্ষণ করে বসেছে। আমি ভয়ে হাত ঝাড়ি দিচ্ছি, কিন্তু হোল্ডার আর আমাকে ছাড়ে না। কোন সময় জানি একটা চিল্লানি দিয়ে সর্বশক্তিতে হাত ঝাড়ি দিয়েছি, তারপর আর কিছু মনে নাই। পরে দেখি যে আমার তর্জনী আর মধ্যমায় ছয়খানা ফোস্কা পড়ে আছে...
*
আমাদের একটা বুড়ো টিয়াপাখি ছিলো। নিয়ম করে দুইবেলা চা বিস্কুট খেতো। খাঁচাবন্দী পাখিটাকে দেখলে আমার পাখিটার সাথে নিজেকেও ভীষণ অসহায় মনে হ'তো কেনো জানিনা। একবার কোনো এক ছুটিতে খুলনা গিয়েছিলাম। বাসায় ফিরে সবাই দেখে পাখির খাঁচা খালি। সবারই মন খারাপ। এতদিনের পোষা পাখিটা এভাবে ঠোঁট দিয়ে খাঁচার দরজা খুলে উড়ে চলে যাবে এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিলো সবারই। আমি কিন্তু উপরে উপরে কষ্ট কষ্ট ভাব দেখালেও ভিতরে ভিতরে খুব খুশি, কারণ বাসা থেকে বের হবার আগে আমিই পাখির খাঁচার দরজাটা খুলে দিয়েছিলাম। এই কথাটা আমি সবার কাছ থেকে গোপন রেখেছিলাম প্রায় এক বছর।
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন